|
|
|
|
সে কালের পলিটব্যুরোয় শেষ বাঙালির প্রয়াণ |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
বিদায় নিলেন সিপিএমের প্রথম জমানার বাঙালি পলিটব্যুরো নেতাদের শেষ প্রতিনিধি। সিপিএমের প্রবীণতম সদস্য সমর মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হল শতবর্ষে এসে। ঘটনাচক্রে, যে সময় ওই জমানার আর এক বাঙালি শীর্ষ কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুর জন্ম শতবর্ষ চলছে।
বৃহস্পতিবার সকালে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ১০০ বছরের সমরবাবুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অবসান হল সিপিএমের আন্দোলন এবং নেতৃত্বের একটি জমানার। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে পৃথক দল হিসাবে সিপিএম গড়ে ওঠার পরে পলিটব্যুরোয় সে কালে দাপট ছিল বাংলার বাইরের নেতাদেরই। একেবারে গোড়ায় জ্যোতিবাবু ও প্রমোদ দাশগুপ্ত এবং তার পরে সমর মুখোপাধ্যায় সেই অধ্যায়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৪০ সালে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৬৬ সালে এবং ১৯৭৮-এ পলিটব্যুরোয়। ১৯৯২-এর পার্টি কংগ্রেসে দলের কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের চেয়ারম্যান হওয়ার আগে পর্যন্ত পলিটব্যুরোয় ছিলেন। পরবর্তী কালে যে পথ ধরে সরোজ মুখোপাধ্যায়, বিনয় চৌধুরী, শৈলেন দাশগুপ্ত, অনিল বিশ্বাস, বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা হাল আমলে নিরুপম সেন, সূর্যকান্ত মিশ্রেরা এই বাংলা থেকে পলিটব্যুরোয় গিয়েছেন, সেই পথের অগ্রপথিক হিসাবে জ্যোতিবাবু, প্রমোদবাবুদের পাশাপাশিই কমিউনিস্ট ইতিহাসে থাকবে সমরবাবুর নাম। নৃপেন চক্রবর্তী, মানিক সরকারেরাও বৃহত্তর অর্থে বাঙালি নেতা হিসাবে পলিটব্যুরোয় স্থান পেয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে সেই ভাবে এ রাজ্যের বাম-আবেগ জড়িত নয়। যা জ্যোতিবাবু বা সমরবাবুর অলঙ্কার ছিল। শতায়ু নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে এ দিন সন্ধ্যায় আলিমুদ্দিনে দাঁড়িয়ে বর্তমান সময়ের পলিটব্যুরো সদস্য নিরুপমবাবুর স্মৃতিচারণ, “সারা দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে যে কয়েক জন বাঙালি নেতার নাম প্রথম সারিতে থাকবে, সমরদা অবশ্যই তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক জীবন শুরু করে পরবর্তী কালে কমিউনিস্ট আন্দোলনে এসেছেন এই যে প্রজন্ম আমাদের দলে ছিল, তার শেষ প্রতিনিধি ছিলেন সমরদাই।”
জীবদ্দশায় শতবর্ষে পা দেওয়ার কৃতিত্ব এমনিতেই বিরল। আগাগোড়া সংযমী জীবনযাপনে যে কৃতিত্ব সমরবাবু অর্জন করেছিলেন। হাওড়ার আমতায় নিজের বাড়ি, পরিবার ছেড়ে আজীবন থেকেছেন পার্টি কমিউনে। বুধবার সন্ধ্যায় দিলখুশা স্ট্রিটের কমিউন থেকেই ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালে। নিরুপমবাবুর কথায়, “পরিণত বয়সে, একশো বছরে মারা গিয়েছেন। বিরল ঘটনা। তবু তাঁর শূন্যস্থান আমাদের কাছে অপূরণীয়। কারণ, যে মূল্যবোধ নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন, আজকের দিনে তাকে বিরলের মধ্যেও বিরলতম বলতে হবে!” বিরলতম এই নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য দিল্লি থেকে এ দিন উড়ে এসেছিলেন পলিটব্যুরোর তিন সদস্য বৃন্দা কারাট, এস আর পিল্লাই এবং এম এ বেবি। ছিলেন বুদ্ধবাবু, বিমানবাবু-সহ দলের গোটা রাজ্য নেতৃত্বই। বাদ যাননি নবতিপর দুই বাম নেতা বিনোদ দাস এবং অশোক ঘোষও। সদালাপী, সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত নেতার প্রয়াণের খবর পেয়ে আলিমুদ্দিনের উঠোনে ভিড় জমিয়েছিলেন সিপিএম এবং তার বাইরেও বহু বাম নেতা-সমর্থক। এসেছিলেন সমরবাবুর পরিজনেরাও। |
 |
সমর মুখোপাধ্যায়ের মরদেহে মালা দিচ্ছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পাশে বিমান বসু।
বৃহস্পতিবার আলিমুদ্দিনে। —নিজস্ব চিত্র |
লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে কুড়ি বছরের সংসদীয় জীবন। তারও আগে উত্তর হাওড়া থেকে বিধায়ক। পরে আবার সিটুর নেতা এবং কন্ট্রোল কমিশনের দায়িত্বে। সংসদীয় রাজনীতি, ট্রেড ইউনিয়ন ও সংগঠন এবং আদর্শ কমিউনিস্ট-সুলভ জীবনযাপন এই তিন বৈশিষ্ট্যেই দলের ভিতরে-বাইরে একাধারে জনপ্রিয় ও ব্যতিক্রমী ছিলেন সমরবাবু। তাঁর মৃত্যুতে শোকাবনত পলিটব্যুরো তাই লিখেছে, ‘সংগঠক, লেখক, শ্রমিক নেতা এবং সংসদবিদ হিসাবে ওঁর অবদান বহুমুখী। ব্যক্তিগত সমস্ত স্বার্থ ছেড়ে ন্যূনতম অনুষঙ্গে পার্টি কমিউনে থেকে দলের কাজ করে গিয়েছেন, এমন মানুষ কমই দেখা যায়। সহজে তাঁর কাছে যাওয়া যেত, মানুষও তাঁকে ভালবাসতেন’।
ভালবাসার দলের দফতর থেকে একশোটি লাল পতাকাবাহী মিছিল-সহ (যেখানে সামিল বিমান, বৃন্দা, এসআরপি, বেবি সকলেই) সমরবাবুর মরদেহ সন্ধ্যাতেই পৌঁছে গিয়েছে এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে। বিনয়বাবু, জ্যোতিবাবুদের মতোই দেহদান করা ছিল তাঁর। দেহান্তে এবং একটি অধ্যায়ের অন্তে আপাতত শূন্য হয়ে গেল দিলখুশা স্ট্রিটের কমিউন! |
|
|
 |
|
|