বিনোদন: মঞ্চে উঠতে চান পোস্ত-রেণুকারা
কী কী দেখাল গো নাটকে,
নাচনি বিয়ে করতে পেল?
গে কারও রেশন কার্ড ছিল না। এখন অনেকের হয়েছে। ভোটার কার্ডও হয়েছে কারও কারও। সেই কার্ডে স্বামীর নামের জায়গায় কেউ কেউ ‘রসিক’-এর নামও লিখেছেন।
ওইটুকুই।
টানা তিরিশ বছর এক পরিবারে থেকেও এখনও ঠাকুরঘরে ঢোকার অনুমতি পাননি রেণুকাবালা। পুরুলিয়ার কেশরগড়িয়া গ্রামের রসিক, সৃষ্টিধর কর্মকারের নাচনি রেণুকার বয়স এখন পঞ্চাশের কোঠায়। এক সারিতে বসে খাওয়া তো দূর অস্ত্, বাড়ির অন্দরমহলে ঢোকারও অনুমতি নেই তাঁর।
বলরামপুরের পোস্তবালার টানা জ্বর চলছে। সঙ্গে কাশি। মানভূম নাচনি উন্নয়ন ও গবেষণা কেন্দ্রের দাওয়ায় বসে পোস্তবালা বললেন, “মানবাজারের হাজারি দেবী এক কালে কত বড় নাচনি ছিল। এই সে দিন ভিক্ষে করতে করতে রাস্তায় পড়ে মরে গেল। আমারও ওই দশাই হবে কি না কে জানে!”
কলকাতার প্রেক্ষাগৃহে নান্দীকারের নতুন নাটক ‘নাচনি’ নিয়ে এখন দর্শকের কৌতূহলের শেষ নেই। প্রায় প্রত্যেকটি শো হাউসফুল হচ্ছে। নাচনিদের জীবনের শোষণ আর যন্ত্রণার রোজনামচা মঞ্চে দেখে চোখ ছলছল করছে শহুরে মানুষের। কিন্তু পুরুলিয়ার গ্রামে গ্রামে নাচনিদের জীবনের গল্প বদলায়নি এক চুলও।
আগে জমিদারদের বাঁধা নাচনি থাকত। জমিদারি প্রথা চলে যাওয়ার পরে আমদানি হয় রসিকদের। তাঁরা এক অর্থে নাচনির ম্যানেজার। গান বাঁধেন, সুর দেন। নাচনির সঙ্গে জুটি বাঁধেন। কিন্তু নাচনির কোনও সামাজিক স্বীকৃতি মেলে না। পুরুলিয়া, ঝাড়খণ্ডের কিছু অংশে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছেন নাচনিরা। বেশির ভাগেরই বয়স হয়েছে। অল্পবয়সী মেয়েরা এখন আর এই পেশায় আসতে চান না। ব্যতিক্রম দু’চার জন। যেমন, বিখ্যাত নাচনি প্রয়াত সিন্ধুবালার নাতনি জ্যোৎস্না। রসিক বিকাশ মাহাতোর পাশে দাঁড়িয়ে বছর কুড়ির মেয়েটি বলেন, “নাচতে-গাইতে ভালবাসি। তাই নাচনি হয়েছি। মরণ জেনেও আগুনে ঝাঁপ দিয়েছি।”
নাচনি রেণুকাদেবীর সঙ্গে রসিক সৃষ্টিধর কর্মকার। সুজিত মাহাতোর তোলা ছবি।
জ্যোৎস্নারই সমবয়সী কোটশিলার চিতোরপুর গ্রামের বিজলিবালা। বিজলি জানেন না, কলকাতার নাটকের মুখ্য একটি চরিত্রের নাম তাঁরই নামে। কেন এলেন এই পেশায়? সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললেন, “সবার কপালে কি আর সুখ থাকে?” রসিক পরমেশ্বরের সঙ্গে চার বছর রয়েছে। সাত মাসের একটি সন্তানও হয়েছে। বিজলির প্রশ্ন, “কী দেখাল গো নাটকে? নাচনিরা বিয়ে করতে পারল?” বিজলির স্বপ্ন, এক দিন পরমেশ্বরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হবে। তিনি সংসার পাবেন।
বিশ্বকর্মাপুজো থেকে কালীপুজো পর্যন্ত নাচনিদের ‘সিজন’। বাজনদার সহ সাত-আট জনের এক-একটি দলের জন্য পাওয়া যায় গাড়িভাড়া আর বড়জোর হাজার তিনেক টাকা। তা দিয়ে ক’দিন চলে? পোস্তবালা, রেণুকারা বলেন, “নাটক হোক আর যা-ই হোক, আমাদের অবস্থা বদলায় না। আর জানোই তো, আমাদের মরেও শান্তি নেই।” নাচনির মৃত্যু হলে দেহ পায়ে দড়ি বেঁধে ভাগাড়ে ফেলে দেওয়াই রেওয়াজ। কারণ প্রচলিত বিশ্বাস, নাচনির দেহ আগুনে পোড়ালে সেই ধোঁয়া বাতাসে বিষ ঢালবে। পুঁতলে মাটি বিষাক্ত হবে।
পোস্তবালার মা নিজের মেয়েকে ৬০ বছরের বড় এক জনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সেই লোক জেলা হাসপাতালে গিয়ে পোস্তর বন্ধ্যত্বকরণের অস্ত্রোপচার করিয়ে আনে। পোস্ত বলেন, “আমার তখন হুঁশ ছিল না। ওই লোকটা নিজের দুই ছেলেকে আমার সন্তান বলে হাসপাতালে জানিয়েছিল।” সব বোঝার পরে বাড়ি থেকে পালালেন। যোগাযোগ হল ডুমারি গ্রামের বিজয় কর্মকারের সঙ্গে। বিজয় তখন নিজের জন্য নাচনি খুঁজছিলেন। শুরু হল তাঁদের জুটি। রেণুকার জীবনের গল্পও কম-বেশি এ রকমই। রেণুকা প্রশ্ন করেন, “এই যে আমাদের এত অপমান, এত কষ্ট! নাটকে তা ধরা পড়েছে? লোকে বুঝেছে আমরা কী ভাবে বেঁচে আছি?”
তবে নাটককে ঘিরে সম্প্রতি শহর থেকে লোকজনের যাতায়াত বেড়েছে। নাচনিদের জীবন নিয়ে মানুষের কৌতূহলও বেড়েছে। সাহস সঞ্চয় করে এ বার নিজেরা সঙ্ঘবদ্ধ হতে চাইছেন নাচনিরা। পোস্তবালার কথায়, “কলকাতায় গিয়ে জমায়েত করতে চাই আমরা। চাই নাটকের কোনও শো-য়ে নিজেরা হাজির থাকতে।
নাটকের শেষে আমাদের কথা আমাদের মুখ থেকেই শুনুন দর্শক, সেটাও চাই।”
নান্দীকারের তরফে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত নাচনিদের এই আগ্রহকে স্বাগত জানিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু তাঁর মতে, “এই নাটক নাচনিদের নিয়ে হলেও শেষ পর্যন্ত এটা মনুষ্যত্বের সংকট, যন্ত্রণার কথা বলে। যে মুহূর্তে নাচনিরা মঞ্চে উঠবেন, সেই মুহূর্তে বিষয়টা খানিকটা প্রোপাগান্ডা-র মতো হয়ে যাবে। সেটা শিল্পের পক্ষে কতটা ঠিক তা জানি না। তবু ভেবে দেখব।”
ও দিকে গরুর জাব দিতে দিতে রেণুকা গান ধরেন, ‘শ্যামের বাঁশি শুনে ও তার নয়নেতে জল...।’ গান শেষ হয় না। কাশি আর কান্নার দমকে গলা বুজে আসে।

রবিবাসরীয় প্রবন্ধ:
কলকাতার কড়চা:

তাঁহারে আরতি করে...
জগন্নাথের অর্চনায় প্রসেনজিৎ। বৃহস্পতিবার, ইসকনের উল্টোরথ যাত্রায়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.