‘বাবুজি’র ছবি, তেজির লাল চুড়ি, সামনে অমিতাভ
ম করে ষাটটা বিজ্ঞাপন পরিচালনা করেছেন অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে। কিন্তু শ্যুটিংয়ের সময় তাঁকে এতটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তে কোনও দিন দেখেননি পরিচালক সুজিত সরকার।
এক সিমেন্ট কোম্পানির বিজ্ঞাপন শ্যুট করতে এসে স্টুডিয়োয় প্রায় এক ঘণ্টা সব কাজকর্ম বন্ধ। অমিতাভ একটি দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে।
একের পর এক ফ্রেম-বন্দি ছবি দেখে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে বিজ্ঞাপনটি সম্পর্কে সুজিতকে দু’একটি প্রশ্ন করছেন। বাদবাকি সময় নীরবতা।
তখন তিনি অতীতের হাত ধরে চলে গিয়েছেন ছেলেবেলায়। এলাহাবাদের বাড়িতে। বাবা-মার কথা ফিরে ফিরে আসছে। কখনও বা ছোট্ট অভিষেকের গল্প। বা কলকাতার বন্ধুদের নিয়ে কিছু স্মৃতি।
এর আগে অমিতাভের সঙ্গে অগুনতি বিজ্ঞাপন শ্যুট করার অভিজ্ঞতা রয়েছে সুজিতের। ক্যাডবেরি থেকে নরেন্দ্র মোদীর গুজরাত পর্যটন দফতর সব ক’টি বিজ্ঞাপন শ্যুটিংই সুজিতের করা। একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যর ছবিও করেছেন অমিতাভের সঙ্গে। নাম ‘শ্যুবাইট’।
কিন্তু এ রকম অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। তবে এর আগে একান্ত ব্যক্তিগত জিনিস ব্যবহার করে কোনও বিজ্ঞাপনও তো করেননি তিনি। এত ছবি, এত বিজ্ঞাপনের শ্যুটিং পার করে আসা সত্তর বছর বয়সী অমিতাভ কেনই বা করলেন এ রকম?
মা তেজি বচ্চনের লাল চুড়ি থেকে শুরু করে নিজের বাড়ির লাইব্রেরিতে রাখা হরিবংশ রাই বচ্চনের লেখা ‘মধুশালা’র একটি কপি কেন এ সব স্বেচ্ছায় দিলেন বিজ্ঞাপনের জন্য?
অনেক কারণের মধ্যে একটি ছিল সিমেন্ট কোম্পানির জন্য তৈরি বিজ্ঞাপনটির কনসেপ্ট। পীযূষ পাণ্ডে আর সুজিত মিলে ঠিক করেছিলেন যে বিজ্ঞাপনটির মূল মন্ত্র হবে মা-বাবার প্রতি ভালবাসা। যার সারমর্ম হল—
মা বাপ কহি নেহি যাতে
বাস অ্যায়সা লাগতা হ্যে কি ওহ চলে গয়ে
পর ওহ যাতে নেহি
কভি ওহ আপকে হোঁটো সে মুসকুরাতে হ্যে তো কভি ওহ আপকে চলনে কে আন্দাজ ম্যে ঝলক যাতে হ্যে...
বিজ্ঞাপনের কথাগুলো শুনেই নাকি বিগ বি-র মন ভিজে গিয়েছিল। ‘ভিকি ডোনার’য়ের পরিচালক খানিকটা আমতা আমতা করেই অমিতাভকে অনুরোধ করে বলেছিলেন, নিজের অ্যালবাম থেকে কিছু ছবি ধার না দিলে বিজ্ঞাপনটা ঠিক জমবে না। পত্রপাঠ রাজি হয়ে যান। সুজিতকে শুধু বলেন, ছবিগুলো যাতে সুন্দর ভাবে ব্যবহার করা হয়। তার পর সিডি, বই, ক্যাটালগবন্দি ছবি দিয়ে দেন। শ্যুটিংয়ের আগে সেগুলো স্ক্যান করে, বিভিন্ন সাইজে প্রিন্ট আউট করিয়ে বাঁধিয়ে ফেলা হয়।
মুম্বইয়ের পারেলের একটা ডিজাইন স্টুডিয়োতে শ্যুটিং হয়েছিল। সেটটা তৈরি করা হয়েছিল অনেকটাই বিগ বি-র এলাহাবাদ, দিল্লি আর মুম্বইয়ের বাড়ির সৃজনশীলতা মাথায় রেখে। সল্ট লেকের বাড়িতে বসে বিজ্ঞাপনের কিছু ‘বিহাইন্ড দ্য সিন’ ছবি দেখাতে দেখাতে সুজিত বলেন, “সেটে ঢুকেই সোজা ওই দেওয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। প্রত্যেকটা ছবি আলাদা করে দেখলেন। দু’একটা ছবি দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা তুই কোথা থেকে জোগাড় করলি?’ আমি বললাম, ‘স্যার এ সব তো আপনিই আমাকে দিয়েছেন।’ ওঁকে দেখে বুঝলাম পুরনো অ্যালবাম ঘাঁটলে সবারই এ রকম লাগে। মনে হয় কোথায় চলে গেল সেই সব মুহূর্তগুলো? মনের মধ্যে উপচে পড়ে সব অনুভূতি।”
নিজের ছোটবেলার ফোটো। জয়া বচ্চনের সঙ্গে বিয়ের ছবি। ছোট্ট অভিষেকের সঙ্গে তোলা ছবি সব ক’টাই দেখলেন। “স্যারের ভাইয়ের সঙ্গে একদম ছোটবেলার ছবিও ছিল। বাবা-মাকে নিয়ে আরও একটা ফ্যামিলি ফোটোগ্রাফ ছিল। কলকাতাতে তোলা ছবিটা বোধহয় এখানে চাকরি করার সময়। তখনকার বন্ধুদের সঙ্গে,” পরিচালক জানান।
কলকাতার প্রসঙ্গ উঠতেই টুক করে আর একটা ছোট্ট খবর দিলেন সুজিত। ‘শ্যুবাইট’ নিয়ে জটটা এখনও না কাটলেও, ইচ্ছেও রয়েছে অমিতাভের সঙ্গে আর একটি ছবি করার। জানালেন, “একটা স্ক্রিপ্ট রেজিস্টার করেছি। এক বাঙালি ভদ্রলোকের চরিত্রে ইচ্ছে আছে স্যারকে কাস্ট করার। চরিত্রের নাম বি বন্দ্যোপাধ্যায়। যদি শেষ পর্যন্ত কাজটা হয় তা হলে ছবির চল্লিশ ভাগ শ্যুটিং কলকাতাতেই করতে চাই। এর বেশি আর কিছু বলব না।” কলকাতাকে নিয়ে আর একটা স্বপ্ন রয়েছে। “গুজরাত পর্যটন নিয়ে এত কাজ করলাম। একবার যদি বাংলার ট্যুরিজমের বিজ্ঞাপন করার সুযোগ পেতাম। ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন’ হিসেবে বাংলাকে দেখতে চাই আমি। নিজের রাজ্যের জন্য চ্যারিটি ওয়ার্ক করতেও আমি রাজি...”
সুজিত সরকার
ইচ্ছাপূরণ কবে হবে তা জানা নেই। সুজিত আবার ফিরে এলেন বিজ্ঞাপনের গল্পে। শ্যুটিংয়ের সময় ছবি দেখতে দেখতে উঠে আসে এলাহাবাদের গল্প। ছোটবেলায় হরিবংশ রাই বচ্চন গল্প বলতে বলতে ছেলেদের অনেক কিছু শেখাতেন। তার মধ্যে অন্যতম গল্পটা ছিল একটা পাথর সরানোকে কেন্দ্র করে। সুজিত বললেন, “এলাহাবাদের তাঁদের পৈতৃক বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা বিশালাকার পাথর রাখা ছিল। স্যারের বাবা রোজ ওটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সরানোর চেষ্টা করতেন। হয়তো রোজ ওটা খুব বেশি হলে এক ইঞ্চি সরানো যেত। কিন্তু বলে না, সবুরে মেওয়া ফলে। একদিন বাড়ির সামনে গিয়ে দেখেন যে এ রকম করতে করতে পাথরটা প্রায় দোরগোড়ার কাছে! গল্পটা শুনে আমি খুব অনুপ্রেরণা পাই।”
শ্যুটিংয়ের ফাঁকে অমিতাভের চোখ পড়ে সেটে রাখা ‘মধুশালা’র একটি কপির দিকে। পুরনো একটা বই আনা হয়েছিল। সেটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে ফোন। খুঁজে বের করতে বললেন বাড়ির কোন তাকে নতুন ‘মধুশালা’র একটা কপি রাখা আছে! আর তার পর নিজের গাড়ি পাঠিয়ে বইটি আনিয়েও নিলেন। বইটিতে নাকি তাঁর ভাইঝির আঁকা কিছু ছবি ছিল। বিজ্ঞাপনটিতে এক মুহূর্তের জন্য দেখানো হয় যে বিগ বি ‘মধুশালা’র পাতা ওলটাচ্ছেন। তার জন্যই এত তোড়জোড়!
বিজ্ঞাপনের কথাগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আরও কিছু পার্সোনাল টাচ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। নেপথ্যে তনুজ টিকুর সুর। আর অমিতাভের গলায় বাবা-মার প্রসঙ্গে ভেসে আসে: ‘কভি ওহ আপকে বেটে কি নাক ম্যে দিখ যাতে হ্যে/ অগর নেহি তো আপকে বেটে কে বেটি কি আঁখ ম্যে ছুপ যাতে হ্যে।’ ওই দৃশ্যটির জন্য সুজিত অনুরোধ করেন যদি অমিতাভ নিজের নাকটা ছুঁয়ে তার পর তেজি বচ্চনের ছবিটাতে তাঁর নাকটাও ছুঁয়ে দেখেন। পরিচালক জানান, “দু’জনের নাকই বেশ টিকালো। তাই ভাবলাম এটা করলে একটা কানেকশন তৈরি হবে। আমি জানতাম যে হরিবংশজি বসে থাকার সময় পা নাড়াতেন। তাই একটা দৃশ্য রিক্রিয়েট করেছিলাম যেখানে শুধু চারটে পা দেখিয়েছি। একজন বৃদ্ধ। আর একটি বাচ্চা ছেলে। দু’জনেই বসে পা নাড়াচ্ছেন। তেজি বচ্চনের একটা বাক্স আমাদের দিয়েছিলেন স্যার। সেখান থেকে নিয়েছিলাম একটা চশমা আর কিছু লাল চুড়ি...”
পরে এসএমএস করে অমিতাভ এবং অভিষেক, দু’জনেই বিজ্ঞাপনটির প্রশংসা করেন। বিশেষ করে সিনেমাটোগ্রাফার কমল নেগির। বিজ্ঞাপনটি অভিষেকের এতটাই ভাল লাগে যে সুজিতকে নিজের ফুটবল টিমে খেলতে ডেকেছেন। সুজিত জানালেন, “বলিউড বনাম টলিউড ফুটবল খেলাটা হলে আমি হয়তো অভিষেকের দলেই খেলব!”
শ্যুটিং শেষে অমিতাভ বাড়ি ফিরে যান। কিন্তু ইউনিটের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় কে কোন ছবি নিয়ে যাবে। ঠিক যে ভাবে ঠাকুর ভাসানের আগে মা দুর্গার অস্ত্রশস্ত্র বাড়ি নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় চলে। এই সেটটা ভাঙার আগেও একই দৃশ্য। সবাই চায় যদি এক টুকরো স্মৃতি বাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। সুজিত নিজেও দু’টি ছবি বাড়ি নিয়ে যান।
শ্যুটিং শেষ হলেও রেশটা থেকে যায়। ফ্রেমবন্দি ছবিগুলোর মধ্যে। আর বাকিটা স্মৃতিতে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.