|
|
|
|
মিটেছে ভোট, দাঁড়ি পড়েনি সন্ত্রাসে
নিজস্ব প্রতিবেদন |
ভোটগ্রহণ পর্ব মিটেছে। দাঁড়ি পরেনি ভোট-সন্ত্রাসে। পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুর, রামনগর, নন্দীগ্রাম-সহ একাধিক জায়গায় মারধর, পাল্টা মারধর, ভাঙচুর, লুঠপাটের ঘটনা ঘটেই চলেছে। বেশ কিছু জায়গায় আক্রান্ত হচ্ছেন তৃণমূল কর্মীরাও।
পটাশপুরের পর এ বার ভগবানপুরে তৃণমূল কর্মীকে অ্যাসিড ছোড়ার অভিযোগ উঠেছে সিপিএমের বিরুদ্ধে। ভগবানপুর ১ ব্লকের কোটবাড় পঞ্চায়েতের শ্যামচক গ্রামে সোমবার রাতে ঘটনাটি ঘটে। বারান্দায় ঘুমোচ্ছিলেন বসন্ত মাইতি নামে ওই তৃণমূলকর্মী। হঠাৎই তাঁর চিৎকার শুনে ছুটে আসেন স্ত্রী সুমিত্রাদেবী। দেখেন রাতের অন্ধকারে একদল লোক বসন্তবাবুর মুখে অ্যাসিড ঢেলে পালাচ্ছে। গুরুতর আহত বসন্তবাবুকে প্রথমে ভগবানপুর গ্রামীণ হাসপাতাল ও পরে তমলুক জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মঙ্গলবার রাতে সুমিত্রাদেবী ছয় সিপিএমের কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। রাতেই শচীন সামন্ত নামে এক সিপিএম কর্মীকে ধরে পুলিশ। বুধবার তাঁকে কাঁথি এসিজেএম আদালতে হাজির করানো হলে ১৪ দিন জেল হাজতের নির্দেশ হয়। প্রসঙ্গত, গত ৮ জুলাই পটাশপুরের খড়াই মোড়েও তৃণমূল কর্মী গঙ্গাধর মাইতির মুখে অ্যাসিড ছুড়ে মারার অভিযোগ উঠেছিল তিন সিপিএম কর্মীর বিরুদ্ধে।সিপিএম অবশ্য তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকেই ওই ঘটনার জন্য দায়ী করেছিল। বসন্তবাবুর মুখে অ্যাসিড ছোড়ার ঘটনাতেও তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথাই বলছে তারা। সিপিএমের দাবি উড়িয়ে দিয়ে স্থানীয় তৃণমূল নেতা স্বপন রায় বলেন, “ভোটের দিন শ্যামচক প্রাথমিক বিদ্যালয় বুথে বসন্তবাবুর সাথে বিবাদ হয় একদল সিপিএম কর্মীর। তারা বসন্তবাবুকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। সোমবার রাতে তারাই বসন্তবাবুর মুখে অ্যাসিড ছুড়ে পালায়।” |
|
আহত আমিরুন বিবি |
এ দিকে, ভগবানপুর ১ ব্লকের বিভীষণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের জলিগোপীনাথপুর গ্রামে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে দলীয় কার্যালয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে এক সিপিএম নেতাকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। প্রহৃত সিপিএমের ভীমেশ্বরী লোকাল কমিটির সদস্য তথা কৃষকসভার নেতা রাজকৃষ্ণ ঘোড়ইকে রাতেই ভগবানপুর গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সুব্রত মহাপাত্রের অভিযোগ, “তৃণমূলের অত্যাচারে রাজকৃষ্ণবাবু দু’বছর ঘরছাড়া ছিলেন। সম্প্রতি ভোট দেওয়ার জন্য বাড়ি ফেরেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তাঁকে বাড়ি থেকে জাগাতিতলা বাজারে তৃণমূলের কার্যালয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে ব্যাপক মারধর করা হয়।” মারধরের কথা স্বীকার করে তৃণমূল নেতা স্বপন রায়ের দাবি, “অত্যাচারী ওই সিপিএম নেতা অতীতে বহু মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা করেছিলেন। বাড়ি ফিরেই তিনি ফের হুমকি দেওয়া শুরু করেন। তাই জনরোষে ওই ঘটনা ঘটেছে। এর সঙ্গে তৃণমূলের কেউ যুক্ত নয়।”
বিক্ষিপ্ত গোলমালের খবর এসেছে কাঁথি মহকুমার রামনগর ও খেজুরি থেকেও। মঙ্গলবার রাতে রামনগরে তৃণমূলের একদল কর্মী-সমর্থক সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক স্বদেশ নায়ককে গ্রেফতারের দাবিতে পথ অবরোধ শুরু করে। তৃণমূল নেতা নিতাইচরণ সার অভিযোগ করেন, রামনগর ১ ব্লকের তালগাছাড়ি ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের শঙ্করপুর এলাকায় তৃণমূলের প্রার্থী হওয়ার দরুন তৃণমূলের অনন্ত মঙ্গলের বাড়িতে স্বদেশ নায়কের নেতৃত্বে একদল সিপিএম সমর্থক আক্রমণ, মারধর ও লুঠপাট চালায়। অভিযোগ, তৃণমূলের পক্ষ থেকে পুলিশকে খবর দেওয়া হলেও পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়নি। এরপর পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে ও স্বদেশবাবুকে গ্রেফতারের দাবিতে তৃণমূল পথ অবরোধ শুরু করে। গভীর রাত পর্যন্ত অবরোধ চলার পর এসডিপিও ইন্দ্রজিৎ বসু ও সার্কেল ইন্সপেক্টর সমীর বসাক ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলে অবরোধ ওঠে।
অন্যদিকে, রামনগর ২ ব্লকের বালিসাই গ্রাম পঞ্চায়েতের পশ্চিম করঞ্জী গ্রামে তৃণমূল ও সিপিএম সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে স্বপন মাইতি, শৈবাল সাহু, প্রাণগোপাল সাহু ও চন্দন সাহু নামে চার তৃণমূলকর্মী আহত হন। তাঁদের স্থানীয় বড় রাঙ্কুয়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রামনগর ২ ব্লক তৃণমূল সম্পাদক মান্স দাস ওই মারধরের অভিযোগ করেন। তিনি জানান, পশ্চিমকরঞ্জী গ্রামের সিপিএমকর্মী আশুতোষ জানার বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওই বাড়ি থেকে একদল সিপিএম দুষ্কৃতী তাদের মারধর করে। সিপিএমের রামনগর জোনাল কমিটির সম্পাদক আশিস প্রামাণিক অভিযোগ অস্বীকার করে পাল্টা অভিযোগ করেন, আশুতোষ জানার বাড়িতেই স্বপন মাইতির নেতৃত্বে একদল দুষ্কৃতী তাঁকে আক্রমণ করে ও বাড়ির সামনে থাকা গাড়িতে ভাঙচুর চালায়। মারধরের অভিযোগ এসেছে খেজুরি থেকেও। অভিযোগ, খেজুরি ২ ব্লকের খেজুরি গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্দল প্রার্থীকে সমর্থন করায় পুখুরিয়া গ্রামের সুশান্ত দাসকে লোহার রড দিয়ে ব্যাপক মারধর করে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে তমলুক জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সুশান্তবাবু ছাড়াও গ্রামের বিষ্ণুপদ দাস, সত্যরঞ্জন দাস এবং তাঁর স্ত্রী শৈবালিনী দাসকেও ব্যাপক মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ। পরে খেজুরি থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। |
আহত বছর বারোর শাহিন আলি শাহ তমলুক হাসপাতালে। |
অশান্তির বিরাম নেই নন্দীগ্রামেও। মঙ্গলবার নন্দীগ্রাম-১ ব্লকের মহম্মদপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বহিচবাড়ি ও নীলপুর গ্রামে তৃণমূল ও কংগ্রেস সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে দুই তৃণমূল সমর্থক আহত হন। বুধবার ওই এলাকায় নীলপুর থেকে তৃণমূলের সমর্থকদের শান্তি মিছিল বের হয়। মিছিল থেকে বহিচবাড়ি গ্রামে কংগ্রেস সমর্থকদের বাড়িতে ঢুকে মারধর ও ভাঙচুর হয় বলে অভিযোগ। ঘটনায় শাহিন আলি শাহ নামে ১১ বছরের এক বালক ও সাবিনা বিবি, আমিরন বিবি নামে দুই মহিলা আহত হয়েছেন। আহতদের প্রথমে নন্দীগ্রাম ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। পরে দু’জনকে তমলুক জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নন্দীগ্রামের ব্লক কংগ্রেস নেতা তথা জেলা পরিষদের প্রার্থী শেখ আশরাফুলতুল্লার অভিযোগ, “মারধর, ভাঙচুর, লুঠপাট করে চলে যাওয়ার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। অভিযুক্তদের কাউকে গ্রেফতারও করা হয়নি।” হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে তৃণমূল নেতা শেখ সুফিয়ান বলেন, ‘‘ভোটের আগে থেকে কংগ্রেস এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইছে। মঙ্গলবার আমাদের সমর্থকদের আক্রমণ করেছিল। বুধবারও হামলা চালাতে এলে স্থানীয় মানুষ তা প্রতিরোধ করেছে।”
এ দিকে, মঙ্গলবার রাতে নন্দীগ্রামের সোনাচূড়া বাজারে স্থানীয় কংগ্রেস প্রার্থী সন্ধ্যা গায়েনের চা-খাবার দোকানে ভাঙচুরের চেষ্টা চালান একদল তৃণমূল সমর্থক। স্থানীয় বাসিন্দারা বাধা দিলে তাঁরা পালিয়ে যান। নন্দীগ্রাম-২ ব্লকের আমদাবাদ-২ পঞ্চায়েত এলাকার টাকাপুরা গ্রামে নির্দল প্রার্থী রঞ্জন জানার বাড়িতে সোমবার রাতে ও তাঁর অনুগামী পল্টু জানার বাড়িতে বুধবার সকালে ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
এ দিনই সকালে ময়নার দক্ষিণ চংরাচক গ্রামের কংগ্রেস প্রার্থী মনোরঞ্জন দাসের স্ত্রী নীলিমা দাসকে মারধর ও তাঁদের আসবাবপত্রের দোকানে ভাঙচুর করার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় তৃণমূল সমর্থকদের বিরুদ্ধে। ময়নার ব্লক তৃণমূল নেতা সুব্রত মালাকার অবশ্য দাবি করেন, ‘‘এই ঘটনা পারিবারিক। এর সঙ্গে দলের কোনও সম্পর্ক নেই।”
এ দিকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তমলুকের শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লকের সোয়াদিঘী গ্রামে তৃণমূল ও সিপিএম সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ৭ জন তৃণমূল সমর্থক আহত হন। এরপর স্থানীয় কাকটিয়া বাজারে সিপিএমের জোনাল অফিসে ও সিপিএম প্রার্থীর দোকানে ভাঙচুর চালান তৃণমূল সমর্থকরা। রাতে স্থানীয় জেলা পরিষদ আসনের সিপিএম প্রার্থী সমরেশ সামন্তের বাড়িতে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তমলুক ব্লকের উত্তর সোনামুই গ্রামে ও বাড়বসন্তগ্রামে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষে দুই তৃণমূল কর্মী আহত হয়েছেন। তাঁদের তমলুক জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তৃণমূলের জেলা সাধারণ সম্পাদক মামুদ হোসেন বলেন, ‘‘এখনও কিছু জায়গায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। প্রশাসনকে কড়া ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।”
|
ছবি: পার্থপ্রতিম দাস। |
|
|
|
|
|