কখন আসবে ভর্তির ফোন, প্রতীক্ষায় মুমূর্ষুও |
সোমা মুখোপাধ্যায় • কলকাতা |
তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা না পেলে যে রোগীর মৃত্যু হতে পারে, সেই রোগীর পরিবারকে বলা হচ্ছে আবেদন পত্র জমা দিয়ে অপেক্ষায় থাকতে। সময় এলে খবর দেওয়া হবে। সেই ‘সময়’ কখনও আসছে পাঁচ-সাত দিন, কখনও বা তারও পরে। তত দিনে রোগীর হয়তো চিকিৎসা পাওয়ার অপেক্ষাটাই শেষ।
কলকাতা-সহ রাজ্যের সর্বত্র সরকারি ব্যবস্থায় সঙ্কটজনক রোগীর চিকিৎসার পরিকাঠামোটাই এই মুহূর্তে গুরুতর সঙ্কটে। বরাত খুব ভাল থাকলে ঠাঁই পাওয়া যায় ইনটেনসিভ থেরাপি ইউনিট কিংবা ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে। নচেৎ নাম লিখিয়ে হাসপাতালের ফোনের অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।
স্বাস্থ্য দফতরের ঘোষণা অনুযায়ী, রাজ্যের সেরা ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটটি রয়েছে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে। কিন্তু সেখানেও মুমূর্ষু রোগী এলে অপেক্ষায় থাকাটাই দস্তুর। রোগীর বাড়ির লোককে আবেদনপত্র লিখে তা কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হয়। তার পরে শুরু অপেক্ষার পালা। গড়ে পাঁচ থেকে ছ’দিন অপেক্ষায় থাকার পরে হয়তো ডাক মেলে। তত দিন বহু রোগী অবশ্য বেঁচে থাকেন না।
এই এসএসকেএমেই রোগীদের ইকো-র জন্য অপেক্ষা করতে হয় প্রায় বছরখানেক। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সম্প্রতি এসএসকেএমে জরুরি বৈঠকের পরে সেই সময় এক ধাক্কায় কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হলেও সিসিইউ-এ ভর্তির অপেক্ষার মেয়াদ এখনই কমার আশা দেখছেন না কেউই।
এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, প্রতিদিন যে বিপুল রোগীর চাপ তাঁদের সামলাতে হয়, তাতে এ ছাড়া উপায় নেই। সিসিইউ-এ রোগীদের মেঝেতে ঠাঁই দেওয়াও সম্ভব নয়। এক কর্তার কথায়, “অন্য অনেক মেডিক্যাল কলেজেই ‘শয্যা নেই’ জানিয়ে রোগীকে পত্রপাঠ বিদায় করা হয়। এখানে তবু একটা সুষ্ঠু ওয়েটিং লিস্ট চালু করা গিয়েছে। তাতে দেরিতে হলেও কিছু রোগী অন্তত চিকিৎসা পাচ্ছেন।”
বস্তুতপক্ষে, সরকারি হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসা পাওয়াটা বহু ক্ষেত্রেই বরাতজোরের উপরে নির্ভর করে। এক সুযোগেই আইটিইউ কিংবা সিসিইউ-এ ঠাঁই পাওয়া কার্যত অসম্ভব। যাঁদের বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার সামর্থ্য রয়েছে, তাঁরা চিকিৎসা পাচ্ছেন। বাকিদের বরাতে দিন গোনা ছাড়া উপায় নেই।
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “রোগীর বিপুল চাপের জন্য এই সমস্যাটা হচ্ছে। শয্যা সংখ্যা যতই বাড়ুক, সকলকে ঠাঁই দেওয়া কঠিন। তবে এই সমস্যার সমাধানের জন্যই ধাপে ধাপে জেলায় ৪০টি আইটিইউ তৈরি হচ্ছে। এতে অন্তত জেলা থেকে কলকাতায় আসা রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমবে।”
১৭০০ শয্যার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে আইসিইউ-এ শয্যা ১২টি। আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১২৬০ শয্যার ১৪টি আইসিইউ-এ। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ১৬টি শয্যা, নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ-এ শয্যার সংখ্যা ৮। এসএসকেএমে সিসিইউ-এ ২০টি শয্যা। এর মধ্যে ১০টিতে ভেন্টিলেটর রয়েছে। সমস্ত মেডিক্যাল কলেজেই একাধিক ভেন্টিলেটর কাজ করে না। ফলে অবস্থা আরও খারাপ হয়।
সরকারি হাসপাতালে আইটিইউ কিংবা আইটিইউ-এর শয্যার ভাড়া প্রতি দিন ৩০০ টাকা। আর বেসরকারি হাসপাতালে দুই থেকে তিন হাজার টাকা। ভেন্টিলেটর প্রয়োজন হলে দিন-প্রতি খরচটা সাত থেকে আট হাজারও হয়ে যায়। সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের পক্ষে দিনের পর দিন যা বহন করা দুঃসাধ্য।
সরকারি হাসপাতালে ঠাঁই না পেয়ে যাঁরা প্রিয়জনের প্রাণ বাঁচাতে এক বার কোনও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে ফেলেছেন, তাঁদের অবস্থাই সবচেয়ে শোচনীয়। বেসরকারি হাসপাতালের খরচ জোগাড় করতে ঘটিবাটি বিক্রি করার জোগাড় হলেও সরকারি হাসপাতালে তাঁদের ঠাঁই হয় না। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলির যুক্তি, তাদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীদের অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে তাঁদের আইসিইউ কিংবা আইটিইউ-এ সরিয়েই তাঁরা কূল পাচ্ছেন না। এর পরে বাইরের বেসরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভর্তি শুরু হলে স্রোতের মতো রোগী আসতে থাকবে। পরিস্থিতি সামলানো যাবে না।
|