হিমোফিলিয়ার চিকিৎসা চলছে দমদমের তমোঘ্ন দত্তের (পরিবর্তিত নাম)। এ দিকে বেশ ক’দিন যাবৎ পেটের অসুখ, কমছেই না। রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ল, হেপাটাইসিস-সি। যার ফলে লিভারের কোষগুলো নষ্ট হতে শুরু করেছে।
কিন্তু হিমোফিলিয়ায় পর্যুদস্ত তমোঘ্ন তো খুব সাবধানে, বিস্তর নিয়ম-কানুন মেনে চলেন! হেপাটাইসিস সংক্রমণ হল কী ভাবে?
এ জন্য রক্ত পরীক্ষার পদ্ধতির দিকে আঙুল তুলছেন বিশেষজ্ঞ-গবেষকদের একাংশ। যার সূত্র ধরে আবার লোকবলে কমজোরির বিষয়টাও উঠে আসছে। কী ভাবে?
বেলেঘাটার নাইসেড-এর বিজ্ঞানী-গবেষকদের বক্তব্য: হিমোফিলিয়ার দরুণ তমোঘ্নকে বার বার রক্ত নিতে হয়। ওই রক্ত থেকেই তাঁর শরীরে হেপাটাইসিস-সি ঢুকেছে। এবং এ প্রসঙ্গে ওঁদের অভিযোগ: বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাঙ্কে সংগৃহীত রক্ত পরীক্ষা করে তবেই তা মানুষের শরীরে ঢোকানোর ছাড়পত্র দেওয়ার কথা। অথচ বহু জায়গায় যে পদ্ধতিতে রক্ত পরীক্ষা হচ্ছে, তাতে হেপাটাইসিস-সি ধরাই পড়ে না!
নিছক অভিযোগ নয়, নিজেদের গবেষণাগারে পরীক্ষা করে এ ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন নাইসেডের ভাইরোলজি বিভাগের গবেষকেরা। তাঁদের এক জন, প্রভাসচন্দ্র সাধুখাঁর কথায়, “আমরা ল্যাবে বিভিন্ন রক্তের নমুনা যাচাই করে দেখেছি, যে সব পদ্ধতিতে রক্ত পরীক্ষা করা হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস-সি ধরা যাচ্ছে না। আমরা কিন্তু এলাইজা ও নিউক্লিক অ্যাসিড টেস্ট (ন্যাট) করে একই নমুনায় হেপাটাইটিস-সি পেয়েছি!” এ সম্পর্কে তাঁদের একটি গবেষণাপত্র সম্প্রতি জার্নাল অফ ভাইরাল হেপাটাইটিস-এ প্রকাশিত হয়েছে।
শহরের চিকিৎসক মহলের একাংশও বিষয়টির গুরুত্ব মানছেন। যেমন এসএসকেএমের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরী বলছেন, “যে ভাবে ব্লাড ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য জায়গায় রক্তের স্যাম্পল পরীক্ষা করা হয়, তাতে অনেক ক্ষেত্রেই হেপাটাইসি-সি ধরা পড়ে না। এটা বিপজ্জনক প্রবণতা।” আর এ জন্য কর্মী ও পরিকাঠামোর ঘাটতির দিকেই আঙুল তুলছেন তিনি। “ব্লাড ব্যাঙ্কগুলোয় যত রক্ত পরীক্ষার জন্য আসে, সেই তুলনায় কর্মী যেমন কম, তেমন বহু জায়গায় ঠিকঠাক যন্ত্রপাতিও নেই। তাই বাধ্য হয়ে র্যাপিড কিটে পরীক্ষা হয়। তাতে হেপাটাইসিস-সি নয়, এড্স-জীবাণুও গলে যেতে পারে।” বলেন অভিজিৎবাবুর। |
বস্তুত চিকিৎসক-গবেষকদের বড় অংশ মূলত এই র্যাপিড টেস্টকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন। যে পদ্ধতিতে রক্ত পরীক্ষা নিষিদ্ধ করেছে জাতীয় এড্স নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (ন্যাকো)। তাদের কড়া নির্দেশ: রক্ত পরীক্ষা করতে হবে এলাইজা পদ্ধতিতে। একমাত্র অত্যন্ত জরুরি পরিস্থিতিতে (এলাইজা কিট না-মিললে) পরিষেবা চালু রাখার স্বার্থে র্যাপিড টেস্ট করা যেতে পারে। কিন্তু নির্দেশের তোয়াক্কা না-করে রাজ্যের বিভিন্ন ক্লিনিক ও বেশ কিছু ব্লাড ব্যাঙ্কে সাধারণ পরিস্থিতিতেও র্যাপিড টেস্ট চলছে বলে গবেষক-চিকিৎসকদের অনেকের দাবি।
এবং এর জেরেই হেপাটাইসিস-সি সংক্রমণ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন প্রভাসবাবু। “আমরা গত ক’বছর ইস্তক দেখছিলাম, হিমোফিলিয়া-থ্যালাসেমিয়ার বহু রোগী লিভার সিরোসিসের উপসর্গ নিয়ে আসছেন। তখনই মনে হয়েছিল, রক্ত পরীক্ষায় কিছু গলদ থেকে যাচ্ছে।” যদিও নাইসেডের গবেষকেরা জানিয়েছেন, এলাইজা পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা কিছু রক্তের নমুনাতেও হেপাটাইটিস-সি ভাইরাস পেয়েছেন তাঁরা। কী করে?
গবেষণাপত্রের ব্যাখ্যা: যাঁদের দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাঁদের রক্তে হেপাটাইটিস-সি থাকলে অনেক সময় এলাইজা পরীক্ষাতেও ধরা পড়ে না। কারণ, ওঁদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরির হার খুব কম। এ ক্ষেত্রে নিউক্লিক অ্যাসিড টেস্ট (ন্যাট) পরীক্ষাই হেপাটাইটিস-সি নির্ণয়ের সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষা বলে প্রভাসবাবুদের দাবি। তাঁরা চাইছেন, সব ব্লাড ব্যাঙ্ক ও ক্লিনিকে রক্ত পরীক্ষার জন্য ন্যাট আবশ্যিক হোক। তবে এর খরচ অনেকটা বেশি। নাইসেড আপাতত দেখছে, ন্যাট-ছাড়পত্র পাওয়া রক্তের দাম কী ভাবে আমজনতার আয়ত্তে রাখা যায়।
খরচ কমলেও সুরাহা হবে কি?
সংশয় থাকছেই। কারণ সেই লোকাভাব। অভিজিৎবাবুর যুক্তি, “যন্ত্র যত বেশি চালকনির্ভর, সরকারি ক্ষেত্রে কার্যকারিতা তত কম। তাই সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে এলাইজা যন্ত্র থাকা সত্ত্বেও কর্মীরা আকছার র্যাপিড টেস্ট করেন।” ন্যাটের জন্য আরও বেশি টেকনিশিয়ান দরকার। তত লোক রাজ্য জোগাতে পারবে কি না, সন্দেহ। “আগে এলাইজা নিশ্চিত হোক! না হলে বড় বিপদ” মন্তব্য অভিজিৎবাবুর।
স্বাস্থ্য-কর্তারা অবশ্য উদ্বিগ্ন নন। রাজ্য এড্স নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (স্যাক্স)-র অতিরিক্ত প্রকল্প-অধিকর্তা হিমাদ্রি সান্যালের দাবি, “সব সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে এলাইজা হয়। কোথাও র্যাপিড টেস্ট হয় না। ওখানে হেপাটাইসিস-সি ভাইরাস ধরা পড়েনি, এমন অভিযোগ আমরা পাইনি।” |