মায়ের জন্য ও-নেগেটিভ রক্ত চাই। কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্ক এবং কলকাতার একাধিক সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে দু’দিন ধরে হত্যে দিয়েও পাননি। অগত্যা মহম্মদ শাকিল বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে চড়া দামে রক্ত কিনেছেন।
বাঁশদ্রোণীর থ্যালাসেমিয়া-আক্রান্ত কিশোরটির রক্তে সদ্য এইচআইভি পাওয়া গিয়েছে। অভিভাবকদের দাবি, রক্তের মাধ্যমে তার শরীরে ওই ভাইরাস ঢুকেছে। ছেলেটি শুধুমাত্র সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে রক্ত নিত বলে তাঁরা জানিয়েছেন। যা শুনে সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মীরাই বলছেন, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেন?
ওঁদের বক্তব্য: টেকনিশিয়ান হাতে গোনা। তাঁদেরই রক্তদান শিবিরে যেতে হচ্ছে, দিনভর কয়েকশো ইউনিট রক্তের গ্রুপিং-সেরোলজিক্যাল টেস্ট-ম্যাচিং করতে হচ্ছে। অনেক জায়গায় তাঁদেরই আবার রক্ত পৃথকীকরণ ইউনিট সামলাতে হচ্ছে। এত কাজের চাপে রক্ত পরীক্ষায় যেমন ত্রুটি থেকে যেতে পারে, তেমন রোগীর বাড়ির লোক খালি হাতে ফিরতে পারেন। যেমন ফিরেছেন মালদহের এক প্রসূতির পরিবার। গাজোলে ব্লাড স্টোরেজ ইউনিট (বিএসইউ)-এ গিয়ে তাঁরা দেখেন, রক্ত অমিল। কারণ ইউনিটের একমাত্র টেকনিশিয়ানকে নিয়ে গিয়ে মালদহ জেলা হাসপাতালে কাজে লাগানো হয়েছে!
লোকবল, পরিকাঠামোর অভাবে এ ভাবেই রাজ্য জুড়ে সরকারি স্তরে রক্ত সংগ্রহ ও বণ্টন প্রক্রিয়া মুখ থুবড়ে পড়েছে বলে অভিযোগ ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। রক্ত-নিরাপত্তা বিভাগের কর্তারাও মানছেন, মূলত প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ানের সংখ্যা কম থাকাতেই এই হাল। ফি বছর রাজ্যে রক্ত সংগ্রহের পরিমাণ কমছে, সংশয় জাগছে পরীক্ষার মান নিয়েও। রাজ্য রক্ত-নিরাপত্তা বিভাগের জয়েন্ট ডিরেক্টর অরবিন্দ বালার কথায়, “টেকনিশিয়ানরা রক্ত-পরিষেবার স্তম্ভ। ৫৮টি সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কের জন্য অন্তত ছ’শো প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান দরকার। রয়েছে টেনেটুনে সাড়ে তিনশো! কী ভাবে রোজের কাজ তোলা হচ্ছে, আমরাই জানি!” |
শূন্য চেয়ার |
ব্লাড ব্যাঙ্ক |
স্থায়ী পদ |
আছেন |
সেন্ট্রাল |
৪৬ |
১২ |
এনআরএস |
১০ |
৪ |
ন্যাশনাল |
৯ |
৩ |
মেডিক্যাল |
৮ |
৩ |
এসএসকেএম |
১০ |
৪ |
হাওড়া জেলা |
৭ |
৩ |
এমআর বাঙুর |
১০ |
০ |
বর্ধমান |
১২ |
৮ |
উত্তরবঙ্গ |
১৪ |
২ |
সংগ্রহে ভাটা* |
ব্লাডব্যাঙ্ক |
২০০৯-১০ |
২০১০-১১ |
২০১১-১২ |
পশ্চিমবঙ্গ |
৫ লক্ষ |
৫ লক্ষ |
৫ লক্ষ |
২২ হাজার |
১৪ হাজার |
৫ হাজার |
কেন্দ্রীয় |
৯৯ হাজার |
৮৪ হাজার |
৭৭ হাজার |
রক্তের পরিমাণ, ইউনিটে। তথ্য: রক্ত নিরাপত্তা বিভাগ |
|
|
বস্তুতই এখন নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা। স্বাস্থ্য দফতরের খবর: বছরখানেক আগে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্কে টেকনিশিয়ানের মারাত্মক অভাব দেখে উত্তরবঙ্গ থেকে ৩৬ জনকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। অথচ সেখানে বিকল্প কর্মী দেওয়া যায়নি। ফলে উত্তরবঙ্গের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের এক টেকনিশিয়ান বলছেন, “আমাদের বছরে ৩০ হাজার ইউনিট রক্ত সংগ্রহ হয়। এ দিকে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে টেকনিশিয়ান পাঁচ জন। বাধ্য হয়ে রক্ত পরীক্ষায় মানের সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে।” কী রকম?
রাখঢাক না-করে তাঁর জবাব, “বেশির ভাগ সময় হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা শিকেয় উঠছে। এলাইজা টেস্টে পাঁচটা রোগের পরীক্ষা আবশ্যিক, সে জন্য ঠিকঠাক ইনকিউবেশন করতে লাগাতার সামনে বসে থাকতে হয়। আমরা তা পারছি না।” সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের এক টেকনিশিয়ানের আক্ষেপ, “ক্রশ ম্যাচিং করা উচিত কুম্বস টেকনোলজি-তে। এতে এক ইউনিট রক্ত ম্যাচিং করতে পৌনে এক ঘণ্টা লাগে। অত সময় দেওয়ার মতো লোক কই?”
তাই ওঁরা কোনও মতে স্লাইডে দেখে ছেড়ে দিচ্ছেন। এতে যে ভুল হওয়ার ষোলো আনা আশঙ্কা, তা-ও উনি নির্দ্বিধায় মানছেন। স্বাস্থ্য-কর্তারা দেখছেন না?
অরবিন্দবাবুর ব্যাখ্যা: স্থায়ী টেকনিশিয়ানের অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১৯৮১ সালের পরে আর বাড়েনি। উপরন্তু ১৯৯৬ সালের পরে স্থায়ী টেকনিশিয়ান নিয়োগ হয়নি। ১৯৯৮-এ স্টেট ব্লাড ট্রান্সফিউশন কাউন্সিলে ৭৮ জন অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ হলেও তাঁদের যোগ্যতা ও ডিপ্লোমার বৈধতা সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠায় আর লোক নেওয়া হয়নি।
অন্য দিকে, জাতীয় এড্স নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (ন্যাকো)-ও পশ্চিমবঙ্গে অস্থায়ী টেকনিশিয়ান নিয়োগ বন্ধ করেছে। “হাতে গোনা লোকদেরই ব্লাড ব্যাঙ্কের পাশাপাশি ম্যালেরিয়া কেন্দ্র, যক্ষ্মা কেন্দ্র, আইটিসিটি ও বিএসইউ-এ ভাগ করে দিতে হচ্ছে।” অসহায় মন্তব্য অরবিন্দবাবুর।
ফলে কার্যত কোনও জায়গাতেই ঠিকঠাক কাজ হচ্ছে না। স্বাস্থ্য দফতরের সহকারী অধিকর্তা (মাতৃস্বাস্থ্য) তথা মুখপাত্র শিখা অধিকারী সম্প্রতি বিভিন্ন বিএসইউ সরেজমিনে দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “গাজোল-চাঁচোল-লাভপুরের মতো একাধিক বিএসইউয়ে একমাত্র টেকনিশিয়ানকে প্রায় হাইজ্যাক করে কাছাকাছি মেডিক্যাল কলেজ বা ব্লক মেডিক্যাল হেল্থ অফিসে বসানো হচ্ছে। বিএসইউয়ে সিজারের রক্ত মিলছে না। এ দিকে প্রসূতি-মৃত্যুর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দায়ী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ।” সরকারি রিপোর্টই বলছে, প্রথম পর্বে প্রস্তাবিত ৬০টি বিএসইউয়ের মধ্যে মেরেকেটে ১৩টি কোনও মতে কাজ চালাচ্ছে।
এই সুযোগে দাঁও মারছে বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক। বেশি টেকনিশিয়ান থাকায় তারাই অধিকাংশ শিবির থেকে সিংহভাগ রক্ত নিয়ে গিয়ে চড়া দামে বেচছে বলে অভিযোগ। রাজ্য এড্স নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (স্যাক্স)-র সহকারী অধিকর্তা হিমাদ্রি স্যানালের স্বীকারোক্তি, “জানি, বিএসইউয়ে এক জনকে দিয়ে চব্বিশ ঘণ্টার কাজ হয় না। কিন্তু উপায় কী?” |