বদলায়নি কিছুই।
সেই খোলা জানলার পাশে ভোটবাক্স। জানলার ও-পারে কিছু মানুষের শ্যেনদৃষ্টি। ভোটারের ছাপ কোন চিহ্নে পড়ছে, তার দিকে তীক্ষ্ন নজর।
দেখেও দেখেও দেখছেন না প্রিসাইডিং অফিসার বা অন্য ভোটকর্মীরা। সাদা ও খাঁকি পোশাকের চার জন পুলিশ লাইন সামলাতেই ব্যস্ত। বুথের পিছনে কী হচ্ছে, দেখার সময় নেই। ভিতরে পোলিং এজেন্ট বলতে তৃণমূলের দু’জন। সিপিএম নেই, কংগ্রেস নেই, নির্দলেরও কোনও এজেন্ট নেই! ফলে, জানলার ও-পারে কী হচ্ছে, সে কথা কে বলবেন?
বুথ: শিরোমণিপুর বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়। নম্বর: ২৫৬/২৬৯। ব্লক: কোতুলপুর। জেলা: বাঁকুড়া। বুথের প্রিসাইডিং অফিসার বরুণকুমার দাস বললেন, “বিরোধী দলের পোলিং এজেন্ট নেই। কেন নেই, জানি না।” ভোটবাক্সের ঠিক পিছনের জানলা খোলা কেন, জানতে চাইলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে চুপ করে গেলেন। ভোট দিয়ে এক বৃদ্ধা রাগের সুরে বললেন, “ভোট দিলেও জ্বালা, না দিলেও জ্বালা। ঘরে এসে বলে আসছে, আমাদেরই দিতে হবে। আবার ভোট দেওয়ার সময় জানলায় মুখ বাড়িয়ে দেখছে ঠিকঠাক চিহ্নে ছাপ দিচ্ছি কি না। এ তো আগের মতোই। তৃণমূল এসে তা হলে নতুন কী করল?” |
এটাই বাস্তব। কোথাও কোনও বদল নেই। বাম জমানায় ঠিক যে ভাবে ভোট হত বাঁকুড়ার এই অঞ্চলে, তৃণমূলের আমলে তার কোনও পরিবর্তন নেই। মাঝে দ্বারকেশ্বর।
এক দিকে হুগলির আরামবাগ। অন্য পারে বাঁকুড়ার জয়পুর, কোতুলপুর। একটা সময় গোটা অঞ্চলটাই ছিল সিপিএমের গড়। তাদের আমলে বিরোধীশূন্য ভোট দেখতেই অভ্যস্ত ছিলেন এখানকার মানুষ। সন্ত্রাসের ভয়ে বিরোধীরা পঞ্চায়েত ভোটে
প্রার্থী দিতে পারতেন না, প্রচার চালাতে পারতেন না। সেই একই
ছবি এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে। তৃণমূলের আমলে। কোতুলপুরের ১৪১টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে ও পঞ্চায়েত সমিতির ২৪টি আসনে সিপিএমের কোনও প্রার্থী নেই। সিপিএম লড়ছে শুধু জেলা পরিষদের ৪টি আসনে। অন্য দিকে কংগ্রেস লড়ছে পঞ্চায়েতের ২৪ ও সমিতির ৫টি আসনে। ফলে গ্রাম পঞ্চায়েতে ১১৬ ও পঞ্চায়েত সমিতিতে ১৮টি আসনে ইতিমধ্যেই বিনা লড়াইয়ে জয়ী হয়েছে তৃণমূল। জয়পুরে আবার পঞ্চায়েত স্তরে ১১৬টি আসন ও পঞ্চায়েত সমিতির ২৫টি আসন বিনা লড়াইয়ে জিতেছে তৃণমূল। লড়াই কেবল জেলা পরিষদের দু’টি আসনে।
সেই জেলা পরিষদের আসন দখল রাখতে মরিয়া তৃণমূল এ দিন ভোটারদের শাসিয়েছে, এই অভিযোগ তুলেছে সিপিএম ও কংগ্রেস। ঠিক যেমন অভিযোগ তৃণমূল বা কংগ্রেস এক সময় করত সিপিএমের বিরুদ্ধে। সিপিএমের কোতুলপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক গৌরহরি পালের দাবি, “আমাদের পোলিং এজেন্টকে মেরে বের করে দিয়েছে। অধিকাংশ বুথেই তৃণমূল ছাপ্পা ভোট মেরেছে। বুথ দখলও করেছে। ভোটারদের ভয় দেখাতে নীরব সন্ত্রাসের সাহায্য নিয়েছে ওরা। বাড়ি থেকে বুথসব জায়গায় ভোটারদের হুমকি দিয়েছে তৃণমূলের লোকজন।” কোতুলপুরের কংগ্রেস বিধায়ক সৌমিত্র খাঁ বা তৃণমূলের প্রতীক না পাওয়া নির্দল প্রার্থী বাসুদেব মুখোপাধ্যায়েরও একই দাবি। তাঁদের মন্তব্য, “এ দিন ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে। বাম জমানার ধারাই রেখেছে পরিবর্তনের সরকার।”
ঘটনাও হল, এ দিন কোতুলপুর ও জয়পুর ব্লক ঘুরে কোথাও একটাও সিপিএমের পতাকা চোখে পড়েনি। ঘাসফুলের পতাকায় মুড়ে রয়েছে রাস্তাঘাট। বুথগুলির বাইরে তৃণমূলের ক্যাম্প আছে। রাস্তায় রাস্তায় দলীয় পতাকা লাগানো গাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা। দুই ব্লকের কোথাও সিপিএমের কার্যত নামগন্ধও নেই। কোতুলপুরের গোপীনাথপুর সরোজবাসিনী হাইস্কুলের বুথেও বিরোধীদের পোলিং এজেন্ট নেই। আবার সিহড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে বিরোধীদের এজেন্ট থাকলেও সিপিএমকে বুথ অফিস খুলতে দেওয়া হয়নি। বুথের চারপাশ জুড়ে তৃণমূলের কড়া নজরদারি। ভোটারদের কানে কানে ফিসফিসানি। বুথের সামনে দীর্ঘ লাইন দীর্ঘতর হচ্ছিল। বুথ জ্যামের অভিযোগ তুললেন বিরোধীরা।
এমনই একটি বুথের সামনে জটলা থেকে এক জন বলে উঠলেন, “আমরা প্রবীরদার (কোতুলপুর ব্লক তৃণমূল সভাপতি প্রবীর গড়াই) লোক। দলেরই ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে বাসুদেব মুখোপাধ্যায় নির্দল প্রার্থী হয়েছেন। তাঁকে জিততে দেব না। সিপিএম-কংগ্রেস তো দূর ছাই!” আর জেলা পরিষদের প্রার্থী প্রবীরবাবুর দাবি, “বিরোধীদের অভিযোগ মিথ্যা। সন্ত্রাসের প্রশ্নই নেই। আসলে প্রার্থী বা বুথে এজেন্ট দেওয়ার মতো ওদের লোক নেই!” বক্তব্যটা খুব চেনা লাগছে না? এক সময় সিপিএম এই ভাষাতেই কথা বলত যে! |