মারধর-ছাপ্পায় এ বার অভিযুক্ত তৃণমূল
নিজস্ব প্রতিবেদন |
বিক্ষিপ্ত অশান্তির মধ্য দিয়েই ভোট হল পশ্চিম মেদিনীপুরে। বৃহস্পতিবার দুপুরে ভোট চলাকালীন সবংয়ের তিনটি বুথে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তৃণমূলের কয়েকজন বুথের মধ্যে ঢুকে ব্যালট পেপার ছিনতাই করে পালান বলে অভিযোগ। এর ফলে দুপুর তিনটে থেকে ভোট বন্ধ হয়ে যায়। ঘটনাটি রাজ্য নির্বাচন কমিশনকেও জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপক সরকার বলেন, “অবাধে বুথ দখল করে ছাপ্পা মারা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় দলের প্রার্থী-এজেন্টদের মারধর করা হয়েছে।” তবে তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি প্রদ্যোৎ ঘোষের দাবি, “শান্তিপূর্ণ ভাবে নির্বাচন হয়েছে। যদি ছাপ্পাই হবে, তাহলে তো বেলা দেড়টা-দু’টোর মধ্যে ভোট শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। বহু বুথে রাত পর্যন্ত ভোটারদের লাইন ছিল কেন?” জেলার নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দীপক ঘোষও বলেন, “নির্বিঘ্নেই নির্বাচন হয়েছে। কিছু অভিযোগ এসেছে। তা খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করা হচ্ছে।”
|
|
|
দাসপুরে আহত সিপিএম কর্মী।
ডানদিকে সবংয়ে কংগ্রেস সমর্থক। —নিজস্ব চিত্র। |
|
বৃহস্পতিবার সকালে ভোট শুরু হয়েছিল নির্বিঘ্নেই। তবে বেলা বাড়তে একের পর এক অভিযোগ আসতে শুরু করে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে।
সবংয়ের বোড়ালে ভোট শুরুর কিছু পরে কংগ্রেস-তৃণমূল সংঘর্ষ বাধে। তৃণমূলের দাবি, সংঘর্ষে দলের নেতা জয়দেব জানা, গোপীনাথ জানা-সহ ১৭ জন কর্মী-সমর্থক জখম হয়েছেন। এই এলাকাতেই সংঘর্ষের সময় দীপঙ্কর ঘোষ নামে এক কংগ্রেসকর্মীর পেটে তির ঢুকে যায়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁকে কলকাতার হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। কংগ্রেসের দাবি, মারধরে তাঁদের সমর্থক নিতাইচন্দ্র মাইতি, বাবলু জানা, প্রতিমা হাজরা-সহ ৪২ জন জখম হয়েছেন। সবং এলাকার ভেমুয়া, দশগ্রাম, মোহাড় পঞ্চায়েত এলাকাতেও সকাল থেকে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। প্রাক্তন মন্ত্রী তথা বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেন, “ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। বোমাবাজি হচ্ছে। নোনামাধবচকে মেয়েদের উপর অত্যাচার হয়েছে।”
|
সবংয়ে ভোট দিলেন মানস ভুঁইয়া। |
বুধবার রাতে পিংলার পাঁচবেড়িয়ায় বাড়ি ফেরার পথে আক্রান্ত হয়েছিলেন সিপিএমের গ্রাম পঞ্চায়েত প্রার্থী অশোক চৌধুরী। তৃণমূলের লোকেরা তাঁর মাথায় টাঙি দিয়ে আঘাত করেন বলে অভিযোগ। তিনি এখন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দুপুরে অশান্তি বাধে ডেবরার শ্রীরামপুরে। মঙ্গল বাস্কে-সহ দুই তৃণমূলকর্মী জখন হন। দাসপুর-১ এর সিঙাঘাইয়ে সিপিএমের পঞ্চায়েত প্রার্থী শ্যামলী পাত্র, বিজেপির পঞ্চায়েত প্রার্থী উষারানি দোলুই প্রহৃত হন।
অন্য দিকে, দাসপুরে প্রিসাইডিং অফিসারকে মারধর করার ঘটনা ঘটে। প্রহৃতের নাম দিব্যেন্দু মণ্ডল। দাসপুর-১ এর নাড়াজোল গ্রাম পঞ্চায়েতের সীমানা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর ভোটের ডিউটি ছিল। বাড়ি ঘাটালে। থাকেন মেদিনীপুরে দফতরের কোয়ার্টারে। তাঁর কথায়, “তৃণমূলের লোকেরা এই বুথটির দখল নিতে চেয়েছিল। আপত্তি করি আমি। দুপুরে খাওয়ার সময় ৩০-৩৫ জন এসে আচমকাই মারধর শুরু করে। তখন কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা বাঁচাতে আসেন। তাঁরাও প্রহৃত হন। গোলমালের খবর পেয়ে বাড়তি পুলিশ বাহিনী এলাকায় পৌঁছয়।” স্থানীয় তৃণমূল নেতা সুকুমার পাত্র অবশ্য দাবি করেছেন, “বিশেষ দলের হয়ে ওই ভোটকর্মী কাজ করছিলেন। মানুষই তার প্রতিবাদ জানায়। দলের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।” |
নারায়ণগড়ে ভোট দেওয়ার পর বিক্ষোভের মুখে সূর্যকান্ত মিশ্র। |
লালগড়, গোপীবল্লভপুর ১ ও ২ ব্লকের কয়েকটি এলাকাতেও শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ করেছে সিপিএম। ধরমপুর অঞ্চলের দামুজানা ও বৈতা অঞ্চলের পলাশি, লালগড় পঞ্চায়েতের পূর্ণাপানি, নেতাই লাগোয়া সয়েরসাই, গোপীবল্লভপুর ২ ব্লকের চর্চিতা পঞ্চায়েতের ৬, ৭ ও ৮ নম্বর বুথে ব্যাপক ছাপ্পা ভোট দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ৭ নম্বর আসনের সিপিএম সমর্থিত এক নির্দল প্রার্থীকে তৃণমূলীরা মারধর করে বলে অভিযোগ। পেটবিন্ধি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৬৩ ও ৬৫ নম্বর বুথে সিপিএম প্রার্থী এবং দলের বুথ এজেন্টদের মারধর করা হয়। তপসিয়াতেও টোটন হেমব্রম নামে এক সিপিএম প্রার্থীকে মারধর করে বুথ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। ঝাড়গ্রাম ব্লকের রাধানগর গ্রাম পঞ্চায়েতের জারালাটায় লোধা-শবর সম্প্রদায়ের ভোটারদের ভোট দিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। সাঁকরাইল ব্লকের রগড়া ও লাউদহে সিপিএম এজেন্টদের বুথে বসতে দেওয়া হয়নি। |
|
|
নজরদারি হেলিকপ্টারও
ছিল
এক জায়গায়। |
টহলে নয়, মেদিনীপুর পুলিশ লাইনেই
দেখা গেল কেন্দ্রীয় বাহিনীকে। |
|
বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে দাঁতন, মোহনপুরেও। সিপিএমের দাঁতন ২ জোনাল কমিটির সম্পাদক আবদুল রহিমের অভিযোগ, “তুরকা পঞ্চায়েতের ১৮টি বুথের সবকটি, তালদা পঞ্চায়েতের ৫টি বুথে, ও জেনকাপুর পঞ্চায়েতের ১৩টি বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট দেয় তৃণমূল। সেক্টর অফিস এমনকী বিডিওকে জানিয়েও কাজ হয়নি।” খণ্ডরুইতে সিপিএমকে ভোট দেওয়ায় চঞ্চল সিংহ নামে এক ব্যক্তিকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ধুকুড়দার সিপিএম সমর্থক অমূল্য দাস মহাপাত্রকেও মারধরের অভিযোগ ওঠে। একই কারণে পুরুন্দার বনবিহারী বেরাকে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে মারধর করা হয়। অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূলের জেলা সাধারণ সম্পাদক শৈবাল গিরি বলেন, “হারবে বলে মিথ্যে সাফাই দিয়ে রাখছে সিপিএম।” |
বৃদ্ধাকে সাহায্য, নয়াগ্রামের এক বুথে। |
মোহনপুরের নীলদা পঞ্চায়েতের ১৬টি বুথে পোলিং এজেন্টই দিতে পারেনি সিপিএম। দাঁতন ১ ব্লকের আঙ্গুয়া ও চকইসমাইলপুর পঞ্চায়েতে বুথ দখল করে ছাপ্পা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে সিপিএম। উত্তর সাউটিয়া প্রাথমিক স্কুলের বুথে ভোটারদের লাইনে সিআরপিএফ-এর লাঠি চালানোর অভিযোগ ওঠে। আহত হন তিন জন। উত্তেজিত ভোটাররা বিক্ষোভ দেখালে সেক্টর অফিস থেকে নির্বাচন কর্মীরা এসে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আনে।
|
ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল ও কৌশিক মিশ্র। |
|