হারিয়ে যাচ্ছে জলাশয়
বর্ষাতেও পাতে নেই পার্শে, পাবদা
সেই কবে আদি মধ্যযুগে প্রাকৃত পৈঙ্গলের লেখায় ধরা পড়েছিল পুণ্যবান বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনের ছবি।
ওখ্গরা ভত্তা, গাইবা ঘিত্তা, মোইলি মচ্ছা, নালিত গচ্ছা দিজ্জই কান্তা খা (ই) পুনবন্তা।
কলাপাতায় গরম ভাতে গাওয়া ঘি, মৌরলা বা ময়না মাছের ঝোল আর নলিতা শাক পরিবেশন করছেন স্ত্রী। এমন যাঁর ভাগ্য, তিনি পুণ্যবান। কিন্তু সেই দিন অতীত। যে ছোট মাছের বিপুল কদর ছিল বাংলায় তার দেখা মেলে না। শুধু মৌরলা বা ময়না নয়— ট্যাংরা, পুঁটি, ফলুই, বেলে, কই, কাজুলি, পাবদা, বাছা, চিতল, শোল, সরপুঁটি, পারশে প্রভৃতি মাছের দেখা পাওয়া ভার। বাংলার খাল-বিল-নালায় বর্ষার জলে এই মাছ একসময় স্বাভাবিক ভাবেই জন্মাত। মিষ্টি জলের এই মাছের আনাগোনা বর্ষার আবির্ভাবে। প্রাকৃতিক অগভীর জলাভূমি এদের স্বাভাবিক আঁতুরঘর। জলাভূমি ভরাট হয়ে বাড়িঘর, বাজার-হাট যত গড়ে উঠছে, ততই মিষ্টি জলের ওই সব মাছ ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। কপালে ভাঁজ পড়ছে মত্‌স্যজীবী, ব্যবসায়ী থেকে সকলের।
উত্পাদন কম তাই বাড়ছে দাম। —নিজস্ব চিত্র।
সরকারি উদ্যোগে, বেসরকারি প্রচেষ্টায় চেষ্টা শুরু হয়েছে প্রাকৃতিক জলাভূমি সংরক্ষণ করে এদের রক্ষা করার। গঙ্গা, জলঙ্গি, মাথাভাঙা, ইছামতী, চূর্ণীর মতো অনেক নদী দিয়ে ঘেরা রয়েছে অসংখ্য জলভূমি। যার মধ্যে অনাতম হাঁসাডাঙ্গার বিল। কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজের ভূগোলের অধ্যাপক এবং গবেষক বলাইচন্দ্র দাসের কথায়, “হাঁসাডাঙ্গা বিল পৃথিবীতে এক এবং অদ্বিতীয়। পৃথিবীর অসংখ্য অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের মধ্যে এটিই একমাত্র বিল, যার মাঝখানে আরও একটি অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ রয়েছে।” রয়েছে হরিণঘাটার ‘ভোমরা বিল’, চাপড়ার ‘পলদা বিল’, কলিঙ্গ বিল, হাঁসখালির ‘গাজনা বিল’, রানাঘাটের ‘আমদা বিল’, চাকদহের ‘কুলিরা বিল’, ‘মগরা বিল’, নবদ্বীপের ‘হংসবাহন বিল’ প্রভৃতি। এই সব খাল-বিলের বেশির ভাগই নানা কারণেই সঙ্কটাপন্ন।
জীববিজ্ঞানী দেবজ্যোতি চক্রবর্তী বলেন, “এই সব খাল-বিল হল দেশীয় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থাত্‌ বর্ষার মরসুমে এই সব জলাশয়ে মাছ, ব্যাঙ-সহ নানান জলজ প্রাণীর বংশ বিস্তার হয়। আবার তাদের খাদ্যও মেলে ওই জলাভূমিতেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ওই সব জলাভূমিই মরে যাচ্ছে। মিষ্টি জলের দেশি মাছ পাবেন কোথায়?”

কই খয়রা
মিষ্টিজলের মাছ। জুন থেকে সেপ্টেম্বর প্রজনন কাল। বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারে। প্রচুর ডিম হয়। জীবনীশক্তি খুব বেশি। ১০০-৩০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন হয়। খাদ্য হল কীটপ্রতঙ্গ।
চাঁদা
পুকুর, খাল-বিলের পরিষ্কার জলে বসবাস। গরমকালে তিন-চারবার প্রজনন হয়। খাদ্য প্ল্যাংকটন। সুস্বাদু।
পাবদা কাজুলি
প্রধানত নদীর মাছ। বর্ষাকালে স্রোতে ডিম পাড়ে। খাদ্য শ্যাওলা। ওজন ২৫-৭৫ গ্রাম। উপযুক্ত জলাভূমির অভাবে ক্রমশ কমে আসছে। অতি সুস্বাদু এই মাছ।

তাঁর কথায়, “বাণিজ্যিক ভাবে ক্রমাগত মাছ চাষ, এলাকার নিকাশি নালাকে এই সব জলাভূমিতে মিশিয়ে দেওয়ায় এবং সংশ্লিষ্ট লোকালয়ের আবর্জনা সরাসরি এই সব জলাশয়ে ফেলার কারণে প্রথমে জলাভূমিটি বন্ধ্যা হয়ে পড়ছে। তার পর তাকে ভরাট করে বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে। এ ভাবে চললে খুব বেশি দিন লাগবে না মিঠে জলের দেশীয় মাছের অধিকাংশ প্রজাতির বিলুপ্ত হয়ে যেতে।”
জলাভূমি রক্ষায় রাজ্য মত্‌স্য দফতর, কৃষি দফতর নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সচেতনতা বাড়াতে আন্দোলনে শামিল হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ।
নদিয়া জেলা মত্‌স্য দফতরের সহ-অধিকর্তা সম্পত্‌ মাজি বলেন, “আমাদের জেলায় ২৬ হেক্টর জলাভূমি রয়েছে। যার মধ্যে নদী-সহ সব ধরনের জলাশয় রয়েছে। এর মধ্যে ১৫ হাজার হেক্টরে মাছ চাষ হয়। নানা কারণে জলাভূমি গভীরতা হারাচ্ছে। বর্ষার জলধারণ ক্ষমতা কমছে। এটা জলাভূমির স্বাস্থ্যের পক্ষে সবচেয়ে বড় বিপদ। তাই আমরা প্রথমে বড় বড় খাল বা বিলগুলি সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছি। পাশাপাশি কোনও জলাভূমি ভরাটের খবর পেলেই আমরা আইনানুগ কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
সংস্কারের পর কী হবে? উত্তরে সম্পত্‌বাবু বলেন, “মিঠে জলের দেশীয় মাছ কিন্তু এখন কৃত্রিম ভাবে প্রজনন করানো যায় না। যেটা রুই কাতলার ক্ষেত্রে সম্ভব হয়েছে। তাই এই সব মরা জলাভূমিতে প্রধানত হারিয়ে যেতে বসা মাছেরই চাষ হবে।”
অন্য দিকে নদিয়ার যুগ্ম কৃষি অধিকর্তা হরেন্দ্র কুমার ঘোষ বলেন, “জেলায় কৃষি দফতরের বিভিন্ন মহকুমায় এগারোটি কৃষি গবেষণা ফার্ম রয়েছে। তার প্রতিটিতে একাধিক জলাশয় রয়েছে। আমরা সেখানে মত্‌স্য দফতরের সাহায্য নিয়ে মত্‌স্য চাষ শুরু করেছি। প্রথমে ১১টি জলাশয় সংরক্ষিত করা হয়েছে মত্‌স্য চাষের জন্য।”
বিজ্ঞান মঞ্চের নবদ্বীপ কেন্দ্রের সম্পাদক অমরেন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা জলাভূমি ভরাটের বিরুদ্ধে পথে নেমেছি। ১৯৭১-এর ইরানের রামসার অঞ্চলে জলভূমি রক্ষায় কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আমরা চাই মানুষ, প্রশাসন জলাভূমি বাঁচাতে এগিয়ে আসুন সক্রিয় ভাবে। না হলে পরিবেশের ভারসাম্য আরও নষ্ট হবে।”

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.