পৃথিবী কি উল্টো দিকে ঘুরিতেছে? হরিয়ানার কুখ্যাত খাপ পঞ্চায়েতের কিছু সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত শুনিলে তেমনটা মনে হইতে পারে। ঝিন্দ জেলার কুড়িটি গ্রামের খাপ পঞ্চায়েত ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ণয় এবং কন্যাভ্রূণ হত্যার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছে। স্বগোত্রে বিবাহের জন্য নবদম্পতিদের নির্মম ভাবে হত্যা করিতে সিদ্ধহস্ত, মেয়েদের পোশাক, আচরণ, ঘরের বাহিরে যাওয়া এবং মোবাইল ফোন ব্যবহারে রকমারি নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করিবার জন্য নিন্দিত হরিয়ানার খাপ পঞ্চায়েত সহসা এত নারী-দরদি হইয়া উঠিল? সিদ্ধান্তগুলি যে মন্দ বা অশুভ, তাহা নয়। বরং পরিণাম বিচার করিলে এগুলিকে স্বাগত না জানানো কঠিন, অনুচিতও।
প্রশ্ন অন্যত্র। যে খাপ পঞ্চায়েত বরাবর নারীকে দমিত রাখিতেই আগ্রহী, তাহারা হঠাৎ করিয়া নারীর মুক্তি ও ক্ষমতায়নে আগ্রহী হইয়া উঠিতেছে? ইহা কি সম্ভব? বাঘ কি তাহার গায়ের ডোরা মুছিতে পারে? সহজ বুদ্ধি বলে, পারে না। এবং সহজ বুদ্ধিকে ঈষৎ কাজে লাগাইলেই ঝিন্দ রহস্য ভেদ করা যায়। রহস্যটি আর কিছুই নয়, লিঙ্গ-নির্ণয় এবং কন্যাভ্রূণ হত্যার প্রকোপ হরিয়ানাকে ক্রমশ নারীশূন্য করিয়া তুলিতেছে। এখনই এই রাজ্যের কোথাও-কোথাও প্রতি হাজার পুরুষে সাত-আটশোর বেশি নারী মিলিতেছে না। কন্যাভ্রূণ হত্যা অব্যাহত থাকিলে বিবাহযোগ্যা নারী হরিয়ানায় বাড়ন্ত হইয়া যাইবে। এখনই পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি অনগ্রসর রাজ্য হইতে হরিয়ানি পুরুষদের স্ত্রী আমদানি করিতে হইতেছে। বিবাহের পর ভাষা-সংস্কৃতি-লোকাচার-অভ্যাস ইত্যাদিতে গভীর বৈসাদৃশ্যের কারণে সেই স্ত্রীদের অনেকেই স্বামীদের পরিত্যাগ করিতেছে। কন্যাভ্রূণ হত্যা ও ভ্রূণের লিঙ্গনির্ণয় হরিয়ানার সমাজে নারীপুরুষের অনুপাত বিপজ্জনক ভাবে হ্রাস করিয়া এমন এক বিস্ফোরক পরিস্থিতির সৃষ্টি করিতেছে, যাহা ধর্ষণ, বলাৎকার, মহিলাদের অপহরণের মতো অপরাধপ্রবণতাও উত্তরোত্তর বাড়াইয়া তুলিতেছে। খাপ পঞ্চায়েতের গ্রাম্য অভিভাবকরা ইহাতেই যৎপরোনাস্তি উদ্বিগ্ন। তাই জনপ্রিয় দুই অনাচার নিষিদ্ধ করিয়া ফতোয়া জারি হইয়াছে।
অর্থাৎ, নারীর ক্ষমতায়ন কিংবা মুক্তির জন্য খাপ পঞ্চায়েতের এই সিদ্ধান্ত নয়, বরং শাসন করিবার মতো পর্যাপ্তসংখ্যক নারী হরিয়ানি সমাজে মিলিতেছে না বলিয়াই তাহাদের উৎকণ্ঠা। লক্ষণীয়, মহিলাদের পোশাক, বাড়ির বাহিরে যাওয়া কিংবা মোবাইল ফোন ব্যবহার করিবার উপর ইতিপূর্বে জারি করা নিষেধাজ্ঞা কিন্তু খাপ মাতব্বররা প্রত্যাহার করে নাই। তথাকথিত স্বগোত্র বিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল বা রদের কোনও প্রস্তাবও খাপের বিবেচনাধীন নয়। অর্থাৎ পরিবারে ও সমাজে মেয়েদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকত্ব লইয়া খাপ কোনও পুনর্বিবেচনা বা পর্যালোচনায় যাইতেছে না। কেবল সমাজে মেয়েদের সংখ্যাবৃদ্ধি তাহার লক্ষ্য। ছড়ি ঘোরাইতে হইলে কতিপয়ের তুলনায় বহুসংখ্যকের উপর ঘোরানোই শ্রেয়। তাহার মজাও আলাদা, তৃপ্তিও সুপ্রচুর। |