রাজনীতিতে প্রচারমাধ্যমের ভূমিকাটি গুরুতর। কিন্তু অধুনা সংবাদ-ফাঁস নামক যে বিশেষ প্রক্রিয়াটির ফলে বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে আকস্মিক ‘বিপর্যয়’-এর এক নূতন ধারা দৃষ্ট হইতেছে, তাহা অবশ্যই প্রচারমাধ্যমের একটি নূতন ক্ষমতার দিকে দৃষ্টিপাত করে। বুঝাইয়া দেয়, রাজনীতির মধ্যে স্বভাবতই যে গোপনতা কিংবা অস্বচ্ছতা এত দিন যাবৎ নিহিত থাকিতে পারিয়াছে, জনমানসে যাহা এত দিনে নিতান্ত স্বাভাবিক হিসাবে স্বীকৃতও হইয়াছে, রাজনীতির সেই স্বভাব-গোপনতা এ বার বিষম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। রাজনীতি তাহার নিজের স্বার্থে প্রচারমাধ্যমকে যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণ করিতে চাহিলেও প্রযুক্তি-মাহাত্ম্যে সে কাজ তাহার আয়ত্তাতীত হইয়াছে। সম্প্রতি অ্যাসাঞ্জের উইকিলিকস্ কিংবা স্নোডেন-এর মার্কিন নিরাপত্তা সংক্রান্ত সংবাদ-ফাঁসের পর আবার আর এক বিশ্বজোড়া ঝড় তুলিয়াছে পাকিস্তানের একটি গোপন রিপোর্ট ফাঁস। এই রিপোর্টের নাম ‘অ্যাবটাবাদ কমিশন’ রিপোর্ট: গত বৎসর মে মাসে মার্কিন যুদ্ধবিমানসমূহ আল কায়দা জঙ্গি গোষ্ঠীর মহানেতা ওসামা বিন লাদেন-এর অ্যাবটাবাদ আবাস আক্রমণ ও ধ্বংস করিয়াছিল। সেই সময়কার পাকিস্তান প্রশাসনের ভূমিকা লইয়াই এই তদন্ত রিপোর্ট। যেহেতু ইসলামাবাদের তীব্র সমালোচনা রহিয়াছে রিপোর্টে, সম্পূর্ণ হওয়া-মাত্র ইহা ধামাচাপার তোড়জোড় শুরু হয়। অতীতে এমন নেতিবাচক রিপোর্ট ইসলামাবাদ অতি সফল ভাবে চাপা দিয়াছে —যেমন অন্যান্য দেশও করিয়া থাকে— ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি প্রশাসনের অনাচারের রূপ অনুধাবন করিতে পাক সরকারি নির্দেশে যে রিপোর্টটি তৈরি করেন প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমান, তাহাতে পাকিস্তানের এত কঠোর সমালোচনা ছিল যে সঙ্গে সঙ্গে তাহাকে চাপিয়া দেওয়া হয়। ২০০০ সালের আগে এই রিপোর্ট জনসমক্ষে আসে নাই।
বুঝিতে কষ্ট হয় না, আল-জাজিরা নামক টেলিভিশন চ্যানেলের অতিসক্রিয়তার ফলে এমন একটি সংবেদনশীল রিপোর্ট অকস্মাৎ গোটা বিশ্বের সামনে খুলিয়া যাওয়ায় ইসলামাবাদের মুখে কতখানি কালি পড়িয়াছে। রিপোর্ট প্রকাশ আরম্ভ হইতে না হইতে পাকিস্তানে এই আরবি প্রচারমাধ্যমটির সমস্ত রকম কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হয়। তত ক্ষণে অবশ্য বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হইয়া পড়িয়াছে সাড়ে তিন শত পৃষ্ঠাব্যাপী এই রিপোর্টে উল্লিখিত বহু তথ্য, ঘটনা, কাহিনি। জানা গিয়াছে কী ভাবে বৎসরের পর বৎসর তাবৎ পাক পুলিশ-প্রশাসন, গোয়েন্দা-গুপ্তচর সকলকে ফাঁকি দিয়া বিন লাদেন অ্যাবটাবাদে থাকিয়াছেন, এমনকী সন্নিহিত অঞ্চলে প্রমোদ-বিহারেও গিয়াছেন। অধিকাংশ পুলিশ কিংবা নিরাপত্তারক্ষী নাকি এই আন্তর্জাতিক অপরাধীটির মুখচিত্রের সহিত পরিচিতই ছিল না। সব মিলাইয়া পাক প্রশাসনের যে গভীর অদক্ষতা ও অপরিণামদর্শিতার চিত্র তুলিয়া ধরে এই রিপোর্ট, তাহা ভয়াবহ। আর যদি ইহার পিছনে গূঢ়তর কোনও অভিসন্ধি লুকাইয়া থাকে, তাহা দ্বিগুণ ভয়াবহ।
ভয়াবহ এই জন্য যে, বিন লাদেন যে অপরাধে অপরাধী, গত কয়েক বৎসরে সেই অপরাধে পাকিস্তানে বহু সহস্রাধিক নিরপরাধ পাকিস্তানি বেঘোরে প্রাণ হারাইয়াছেন, সন্ত্রাসের দাপটে দেশটি ছারখার হইয়া গিয়াছে বলিলে অত্যুক্তি হয় না। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট-সহ একাধিক প্রথম সারির নেতাও সন্ত্রাসী হানায় হত হইয়াছেন। তবু প্রশাসন জাগে নাই। তবু প্রশাসন বুঝিতে পারে নাই যে, ‘আন্তর্জাতিক বনাম জাতীয়’ এই দ্বিত্বে বিভাগ করিয়া সন্ত্রাসের মতো বিপদের মোকাবিলা করা যায় না। বুঝিতে পারে নাই যে সমস্ত ক্ষমতা কেবল ভারতীয় সীমান্তের দিকেই নিবদ্ধ করিয়া দেশের অন্যান্য সীমান্ত লইয়া মাথা না ঘামাইলে সমস্যার সমাধানে পৌঁছনো যায় না। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নওয়াজ শরিফ নাকি এ বিষয়ে তাঁহার পূর্বসূরিদের অপেক্ষা বিচক্ষণতর। তিনি কি এই রিপোর্ট-ফাঁসের পর দেশের প্রশাসনিক দর্শনটি লইয়া পুনর্বার ফিরিয়া ভাবিবেন? কেবল তাঁহার নিজের দেশের নাগরিকের নিরাপত্তাই নহে, বহির্বিশ্বের নিরাপত্তা নিশ্চিত করিতেও ইসলামাবাদের এই বিপজ্জনক বিলাস-নিদ্রা হইতে জাগিয়া ওঠা জরুরি, জরুরি কঠোর আত্মসমীক্ষণ। |