বিধানসভা ভোটের আগে যে বিষয়টি নিয়ে তৃণমূল লাগাতার প্রচার চালিয়েছিল, পঞ্চায়েত ভোটে সেই জবাবই এখন রাজ্যের শাসকদলের কাছে চাইছেন রঘুনাথপুরের নতুনডি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার মানুষ। এক সময় সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যা ছিল তৃণমূলের হাতিয়ার, আজ সেটাই তাদের কাছে ব্যুমেরাং!
জমি অধিগ্রহণ হওয়া সত্ত্বেও শিল্প কি আদৌ হবে? হলে কবে?এই সব প্রশ্নের জবাব না পেয়েই আজ, বৃহস্পতিবার ফের একটি ভোটের লাইনে দাঁড়াবেন নতুনডির মানুষজন। যেমন দাঁড়িয়েছিলেন আড়াই বছর আগে। দলটাই যা বদলেছে। তখন জবাব ছিল না সিপিএমের কাছে। আজ নেই তৃণমূলের। বস্তুত, সিপিএম গত এক মাস ধরে লাগাতার শিল্প না হওয়ার বিষয়টিকে সামনে রেখে ওই এলাকায় প্রচার চালিয়েছে। ছোট ছোট সভা করে সিপিএম প্রচার করেছে, তাদের আমলে শিল্প গড়ার কর্মকাণ্ড শুরু হলেও তৃণমূলের ‘দিশাহীন’ শিল্পনীতির কারণে নতুনডি এলাকায় শিল্পের সম্ভবনা বিনষ্ট হচ্ছে। ঘটনা হল, শিল্প না হওয়ায় এলাকার মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জমেছে যথেষ্টই। |
সিপিএমের এই প্রচারের লাগসই পাল্টা দিতে পারেনি তৃণমূল। বস্তুত, শিল্প নিয়ে দলের স্থানীয় নেতৃত্ব বিশেষ উচ্চবাচ্যও করছেন না। সম্প্রতি এলাকায় সভা করতে এসে এলাকার শিল্পায়ন নিয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সম্পাদক মুকুল রায়ের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ছিল, “রঘুনাথপুরে ইন্ড্রস্টিয়াল পার্ক হবে। তিনটি সংস্থা জমি চেয়েছে। ২৭ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে ৩৭ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে।” শুকনো আশ্বাসে অবশ্য চিঁড়ে ভিজছে না। সিপিএমের পুরুলিয়া জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য প্রদীপ রায়ের কটাক্ষ, “তৃণমূলের মুখই নেই তো কিছু বলার! তাই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।”
রঘুনাথপুর ১ ব্লকের এই নতুনডি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১২টি আসনের সঙ্গেই শিল্পের প্রশ্নটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়কের এক পাশে জয় বালাজির প্রস্তাবিত ইস্পাত করাখানার জন্য দুরমুট, হুড়রা, জোরাডি ও নতুনডি মৌজায় বাম আমলে জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। রাস্তার অন্য ধারে আবার শ্যাম স্টিলের ইস্পাত কারখানার জন্য কেলাহি, লছমনপুর, নামোবাথান ও গগড়া এলাকায় জমি নেওয়া হয়েছিল বাম জমানায়। আটটি মৌজা মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার একর জমি অধিগ্রহণ হলেও কারখানা গড়ার পক্রিয়া শুরুই হয়নি। পরে শ্যাম স্টিল চিঠি দিয়ে রাজ্য সরকারকে জানিয়ে দেয়, রঘুনাথপুরে তারা কারখানা গড়তে ইচ্ছুক নয়। বালাজি গোষ্ঠীরও দাবি, প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জমি হাতে না পাওয়া এবং যে পরিমাণ জমি তাদের হস্তান্তরিত করা হয়েছে, সেই জমির লিজ চুক্তি রাজ্য সম্পন্ন না করায় তাদের কার্যত হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে।
নতুনডি এলাকায় মানুষ স্বেচ্ছায় জমি দিয়েছিলেন শিল্প গড়তে। তাঁদের আশা ছিল, শিল্প হলে কর্মসংস্থান হবে। এলাকার অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে। এখন ওই আটটি মৌজার জমির মালিক, বর্গাদার, পাট্টাদার মিলিয়ে হাজার চারেক লোকের কাছে এলাকায় শিল্পায়নের ভবিষ্যৎ একটা বড় প্রশ্ন। প্রদীপবাবুর দাবি, “বাম সরকার এখানে শিল্প গড়ায় উদ্যোগী হয়েছিল। অথচ আড়াই বছর পার অধিগৃহীত জমিতে শিল্প গড়তে ব্যর্থ তৃণমূলের সরকার।” এই সময়ের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী তিন বার জেলা সফর করেছেন। পুরুলিয়ার শিল্প সম্ভাবনা নিয়ে নানা প্রতিশ্রুতিও শোনা গিয়েছে তাঁর মুখে। নতুনডিতে কিন্তু শিল্প হয়নি আজও।
এই অবস্থায় এলাকায় জমি ফেরতের দাবি উঠছে। পঞ্চায়েত ভোটে এই কাঁটা তাই খচখচ করছে তৃণমূলের গলায়। এলাকায় আগে তৃণমূলের সঙ্গে মিলে ‘কৃষি রক্ষা কমিটি’ গড়ে জমি ফেরতের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল এসইউসি। তৃণমূল কমিটি থেকে সরে যাওয়ার পরে ‘জমিহারা কমিটি’ গড়ে একই দাবি প্রশাসনিক স্তরে জানিয়েছে এসইউসি। দলের স্থানীয় নেতা শ্রীলোক মাজি বলেন, “বাম সরকারের আমলে জমি নেওয়ার পরেও শিল্প হয়নি। তৃণমূলের সরকারও শিল্প গড়তে উদ্যোগী হয়নি। জয় বালাজি গোষ্ঠী হাতে পাওয়া জমির শ্রেণি চরিত্রের বদল ঘটিয়ে ফেলায় ওই জমিতে চাষ করাও সম্ভব নয়। এলাকার মানুষ বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য পাশের আসানসোলে দিনমজুরির কাজ করতে যাচ্ছেন। জমিদাতারা বুঝে গিয়েছেন শিল্প হবে না। তাই জমি ফেরতের দাবি জানাচ্ছেন।”
তৃণমূলের অবশ্য দাবি, শিল্প না হওয়ার জন্য সিপিএমই দায়ী। রঘুনাথপুর ১ ব্লক তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি প্রদীপ মাজি বলেন, “সিপিএমের নেতারা নতুনডি এলাকায় যে শিল্পগোষ্ঠীগুলিকে নিয়ে এসেছিলেন, তাদের কারখানা করার ক্ষমতাই নেই! শিল্পের নামে জমির দালালি করেছেন সিপিএমের স্থানীয় নেতারা।” তাঁর সংযোজন “ইতিমধ্যেই আমরা বিধায়কের মাধ্যমে রাজ্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছি, জমি ফেরত নিয়ে কারখানা গড়তে সক্ষম বড় মাপের শিল্পগোষ্ঠীকে নতুনডি এলাকায় জমি দেওয়া হোক।” |