সেই রাজা নেই। নেই রাজ্যপাটও। সুবে বাংলা খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে বাংলা বিহার ও ওড়িশায় বিভক্ত হয়েছে। বিভাজন প্রক্রিয়ায় ছেদ পড়েনি। পদ্মার দুপাড়ের অখণ্ড রাজ্যপাট পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গে খণ্ডিত হওয়ার পর অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির জনপদ গিয়েছে পৃথক দু’টি রাষ্টের চৌহদ্দির মধ্যে। ওই ক্ষত সত্ত্বেও আজও টিকে রয়েছে দুই বাংলার ও দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের ঐতিহাসিক মিলনমেলা--লালগোলার রাজবাড়ির রথযাত্রা।
মুর্শিদকুলি খাঁ তখন সুবাবাংলার নবাব। ভাগ্যন্বেষণে উত্তরপ্রদেশের সহোদর লাল রায় ও ভগবান রায় পৌঁছলেন পদ্মাপাড়ের লালগোলায়। নবাবের থেকে রায়তি স্বত্বে পাওয়া জমিতে তাঁরা বিস্ময়কর পরিমাণে ধান ফলালেন। নবাবকে প্রাপ্যের অতিরিক্ত দিয়েও ধান মজুত রাখতে পাশাপাশি দু’টি থানা এলাকায় বিশাল দু’টি গোলা তৈরি করলেন। ধান্যগোলা দু’টির উচ্চতা বৃক্ষরাজির মাথাও টপকে গেল। ওই কাহিনি শুনিয়ে লালগোলার রাজপরিবারের দেখভালের দায়িত্বে থাকা সেবাইত সৌরভ রায় বলেন, “গোলা দু’টি দেখে দিলখুশ নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ লাল রায়ের নামে লালগোলা ও ভগবান রায়ের নামে ভগবানগোলা নামকরণ করেন। সেই থেকে পাশাপাশি দু’টি থানা এলাকার ওই নামই বহাল রয়েছে।”
সংসদের পূর্বতন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ও মনীষী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ওই রাজপরিবারের জামাই। কয়েক বছর আগে প্রয়াত লালগোলার রাজা বীরেন্দ্রনারায়ণ রায় রাজ্যের বিধানসভার বাম বিধায়কের পদ সামলেছেন টানা সিকি শতক। এ হেন রাজবাড়ির রথযাত্রার জৌলুস আগের থেকে অনেকটা কমলেও সম্প্রীতির মেলবন্ধনের ঐতিহ্য কিন্তু আজও অটুট। লালগোলার রাজপুরোহিত মৃত্যুঞ্জয় পাণ্ডে, স্থানীয় বাচিক শিল্পী পীতম্বর সরেঙ্গি ও সমাজকর্মী সারজামান শেখ বলেন, “ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষ বিদ্বজ্জনেদের সঙ্গেই বরাবরের মতো গত বছরও দুই বাংলার অজস্র মানুষ লালগোলার রথবাজারে রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে সমবেত হয়েছিলেন। সীমান্তক্ষী বাহিনীর প্রহরা বা উত্তাল পদ্মার ৮ কিলোমিটার বিস্তৃত জলস্রোতের ভ্রুকুটিও কোনও বাধা হয়নি বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা ও গোদাগাড়ি উপজেলার সাংস্কৃতিক সমন্বয়কামী জনতার কাছে।”
ওই ঐতিহ্যে এ বারই সাময়িক সময়ের জন্য ছেদ পড়েছে। শিয়রে পঞ্চায়েত ভোট। ফলে সীমান্ত এখন ‘সিল’ করে দেওয়া হয়েছে। তার উপরে আজ বৃহস্পতিবার থেকে এক মাস ধরে রোজা। মেলা জমে সন্ধ্যায়। রোজার ইফতারি ও নমাজও সন্ধ্যায়। মাস খানেক ধরে চলা লালগোলার ওই ঐতিহ্যের মেলায় অংশগ্রহণকারীদের শতকরা ৭৫ ভাগই মুসলিম সম্প্রদায়ের। ফলে উদ্ভূত ওই পরিস্থিতি সামাল দিতে লালগোলার মেলা কমিটিও নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্থানীয় স্কুল শিক্ষক জাহাঙ্গির মিঞা বলেন, “রথযাত্রা ঘিরে লালগোলায় ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষ এতটাই আত্মিক যোগ রয়েছে যে শৈশবে দেখেছি, রথের সময় মুসলিম পরিবারের মেয়েজামাইকেও নিমন্ত্রণ করে লালগোলায় বাপের বাড়িতে নিয়ে আসা হত। ”
রাজবাড়ির রথ প্রসঙ্গে লালগোলার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্তা রতন ঘোষ বলেন, “আদিতে পিতলের রথটি ছিল পুরীর আদলে ৪০ ফুট উঁচু। রথের সামনে ছিল পিতলের দু’টি ঘোড়া। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে পোঁতা হল বিদ্যুতের ও টেলিফেনের খুঁটি। খুঁটিতে টাঙানো হল তার। ৪০ ফুট উঁচু ৮ তলার রথের গতি রুদ্ধ হল তারে। কোপ পড়ল রথে। রথের ৩টি তলা ছেটে ফেলে করা হল ৫ তলার ২৫ ফুট উচ্চতার রথ। চুরি গেল একটি পিতলের ঘোড়া। অন্য ঘোড়াটিও খুলে রাখা হল।” ৪ বিঘা এলাকা জুড়ে জগন্নাথ দেব (দধি বামন দেব)-এর মাসির বাড়িতে অর্থাৎ রাজবাড়ির নাটমন্দির লাগোয়া এলাকায় বসতো মাসখানেকের রথের মেলা। সেই থেকে ওই এলাকার নাম হয় রথবাজার।
ওই লোকবিশ্বাসের ভিত আরও মজবুত রানি ভবানী প্রতিষ্ঠিত জিয়াগঞ্জের সাধকবাগের রথ ঘিরে। এখানের ‘ঠুটো’ জগন্নাথের কল্যানেই নাকি বন্ধ্যানারীর সন্তান লাভ হয়। ফলে ২৬৭ বছরের প্রাচীন ওই রথের রশি টানতে এখনও দূর দূরান্ত থেকে মহিলারা ভিড় জমান। নাটোরের রাজা রামাকান্ত রায় ও রানি ভবানী ১১৪৯ বঙ্গাব্দে রামানুজ অনুগামী আওলিয়া বৈষ্ণব সম্প্রাদায়ের ৩২ চাকা আর ১৭ চূড়ার ওই রথের প্রতিষ্ঠা করেন। জিয়াগঞ্জের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সমীর ঘোষ বলেন, “একদা ভাগীরথীর ভাঙনে রথ তলিয়ে যায়। তারপর ১৩২৭ বঙ্গাব্দে মেদিনীপুরের মহিষাদলের সহোদর দুই রাজা সতীশচন্দ্র গর্গ ও গোপালচন্দ্র গর্গ নতুন দু’টি রথ তৈরি করে দেন।” পরবর্তীতে তৈরি ছোট আকৃতির দু’টি রথের উপর ভর করেই বর্তমান প্রজন্মের মহিলারা মনস্কামনা পূরণে সচেষ্ট।
মুর্শিদাবাদ জেলার ঐতিহ্যের রথের তালিকায় রয়েছে লালবাগের নশিপুর রাজবাড়ির রথ ও নশিপুর আখড়ার মহন্তদের রথ। অধিকাশ ক্ষেত্রে নারীর ঠাঁই পিছনের সারিতে হলেও অরঙ্গাবাদের তাঁতিপাড়ার প্রাচীন রথের চাকা কিন্তু গড়ানোই যায় না রশিতে নববধূর হাতের ছোঁয়া না-লাগা পর্যন্ত। রথ কমিটির কর্তাদের কথায়, “অরাঙ্গাবাদের ওই রথকে ঘিরে ৮ দিন ধরে মেলা বসে। রথযাত্রার মেলা আসলে মিলন মেলা।”
কান্দির প্রয়াত রাজা অতীশ সিংহের বাড়ির রথের বয়স আড়াইশো বছরেরও বেশি। কাশিমাবাজারের ছোট রাজবাড়ির রথের ইতিহাসও প্রায় ৩০০ বছরের। সময় বদলেছে, বদলেছে রথযাত্রার চরিত্রও। বহরমপুর শহরের গোরাবাজার ফাঁড়ি ও পুরনো হাসপাতাল মোড়ের রাজপথের দু’টি বারোয়ারি রথের মেলায় পাওয়া যায় বদলে যাওয়া ধর্ম-সংস্কৃতির ওম। |