|
|
|
|
ভোটের জঙ্গলমহল |
হাত ধরাধরির খেলায় অগ্নিপরীক্ষা তৃণমূলের |
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
‘জঙ্গলমহলে দু’বছরের উন্নয়ন দিয়ে ৩৪ বছরের বঞ্চনার মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাই উন্নয়নের পাশাপাশি এলাকায় শান্তির পরিবেশ নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে তৃণমূলকেই ভোটে জেতাতে হবে।’পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের এটাই ‘ক্যাচলাইন’।
জঙ্গলমহলের আনাচে কানাচে কান পাতলেই গুঞ্জন, নিজেদের দু’বছরের উন্নয়ন কর্মসূচিতে আস্থা রাখতে পারছে না শাসকদল। দারিদ্র ও বঞ্চনার জঙ্গলমহলে রাজনীতির সুরটা তো জঙ্গলের আড়াল থেকে বেঁধে দেওয়া হয়! সেখানে প্রতিশ্রুতি ও তার বাস্তবায়ন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের মাঝেও ‘ওদের’ প্রসঙ্গ এসে পড়ে। ঝাড়খণ্ড লাগোয়া বেলপাহাড়ির শিমুলপাল অঞ্চলের গ্রামের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, “রাতের বেলা ‘ওরা’ চুপি, চুপি আসে।” ওড়িশা লাগোয়া গোপীবল্লভপুর ও নয়াগ্রামের প্রত্যন্ত গাঁ-গঞ্জেও মাঝে সাঝেই চলমান অশরীরীদের ছায়ার উদয় হচ্ছে। ২০১১ সালের নভেম্বরে জামবনির বুড়িশোলের জঙ্গলে যৌথ বাহিনীর গুলিতে কিষেণজি নিহত হওয়ার দেড় বছর পর জঙ্গলমহলের রাজনৈতিক সমীকরণ যে অনেকটাই বদলে গিয়েছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীরা। সোমবার লালগড়ের সভাতেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছিলেন, মাওবীদের আত্মঘাতী বাহিনী তাঁকে ও তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রীদের খুন করার ছক কষছে। তাই এ বার ভোটের জঙ্গলমহলে শেষলগ্নে বাড়তি বাহিনী এসেছে। বেলপাহাড়ি থেকে লালগড়, কিংবা গোপীবল্লভপুর থেকে নয়াগ্রাম সর্বত্রই আঁটোসাঁটো নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য গিজগিজ করছে সশস্ত্র বাহিনী।
ঝাড়গ্রাম মহকুমার ৮টি ব্লকের মোট বুথের সংখ্যা ১০২৬টি। সবগুলিই স্পর্শকাতর। এর মধ্যে অতিস্পর্শকাতর ৭০৬টি বুথের প্রতিটিতে ৮ জন করে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন থাকবে। বাদবাকি ৩২০টি বুথের প্রতিটিতে থাকবে ৪ জন করে পুলিশ। তবে, অভিযোগ উঠছে, সর্বত্র এই নির্দেশ মানা হচ্ছে না। ভোটের আগের দিন অনেক বুথেই মাত্র দু’-চার জন লাঠিধারী পুলিশ পৌঁছেছেন। শুধুমাত্র ১০২৬টি বুথের জন্যই প্রায় সাত হাজার সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হচ্ছে। প্রশাসন সূত্রের খবর, জঙ্গলমহলের ক্ষেত্রে বুথের নিরাপত্তার জন্য সশস্ত্র পুলিশের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় বাহিনীও থাকবে। |
|
নেদাবহড়ায় ছোটদের হাতেও উড়ছে তৃণমূলের পতাকা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ। |
২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে মহকুমার ৮টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে লালগড় বাদে বাকি ৭টি দখল করেছিল সিপিএম তথা বামেরা। নয়াগ্রাম, সাঁকরাইল, বেলপাহাড়ি ও লালগড়ের অনেক জায়গায় তখন তৃণমূল-সহ বিরোধীরা কোনও প্রার্থী দিতে পারেনি। ওই বছরেই শেষ দিকে শালবনি থেকে ফেরার সময় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়ে মাইন বিস্ফোরণের জেরে পুলিশি নিগ্রহের অভিযোগকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে ওঠে জঙ্গলমহল। পরের তিন বছর জঙ্গলমহল দাপিয়ে বেড়িয়েছে মাওবাদী ও জনগণের কমিটি। ২০১০ সালের শেষ নাগাদ সিপিএম জঙ্গলমহলে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও ২০১১-এর জানুয়ারিতে লালগড়ের নেতাই গ্রামে চার মহিলা সহ-৯ গ্রামবাসীর নিহত হওয়ার ঘটনা সিপিএমের কফিনে পেরেক পুঁতে দেয়। খুন-সন্ত্রাসের অধ্যায় পেরিয়ে ২০১১ সালের মে মাসে রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় তৃণমূল আসার পরে রাতারাতি জঙ্গলমহলে সিপিএমের সংগঠন কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে। ঝাড়গ্রাম মহকুমার চারটি বিধানসভার মধ্যে তিনটি (ঝাড়গ্রাম, গোপীবল্লভপুর ও নয়াগ্রাম) সিপিএমের হাতছাড়া হয়। কেবলমাত্র ঝাড়খণ্ডীদের দখলে থাকা বিনপুর বিধানসভা আসনটি সিপিএম পেয়েছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত বছর সিপিএমের দখলে থাকা গোপীবল্লভপুর-২ পঞ্চায়েত সমিতির সিপিএম সভাপতি ও সদস্যরা ইস্তফা দেওয়ায় ওই পঞ্চায়েত সমিতিটি তৃণমূলের ক্ষমতাসীন হয়ে যায়। গত বছর আবার বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির সিপিএম সভাপতির বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে ক্ষমতা দখল করে নেয় ঝাড়খণ্ডীরা। জঙ্গলমহলে সিপিএম, কংগ্রেস ও ঝাড়খণ্ড পার্টির অনেক কর্মী তৃণমূলে নাম লিখিয়েছেন। প্রাক্তন মাওবাদী ও জনগণের কমিটির একটি অংশ তৃণমূলে যোগ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলীয় পদ পেয়েছেন। কিন্তু বেলপাহাড়ির সুমিত্রা সিংহ সর্দার, নয়াগ্রামের লেদেম হেমব্রম কিংবা লালগড়ের ভূষণ মাহাতোদের আক্ষেপ, “কিছুই বদলায়নি। পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি। শাসকদলের নেতাদের কেবল মুখগুলি বদলেছে। নয়াগ্রামের তৃণমূল নেতারা এখন অনুজ পাণ্ডেদের মতো জীবন যাপন করছেন। এক সময়ে খুন, সন্ত্রাস অপহরণ ও তোলাবাজির অভিযুক্তরা এখন শাসকদলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাম জমানার মতো এখনও মিথ্যা মামলায় বিরোধীদের জেলে পোরা হচ্ছে।”
তৃণমূলের সরকার জঙ্গলমহলে উন্নয়নের যে প্রচার করছে, তা-ও ভিত্তিহীন বলেই দাবি সিপিএমের। সিপিএমের প্রবীণ জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ডহরেশ্বর সেন প্রশ্ন তুলেছেন, “গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নটা কোথায় হচ্ছে? মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, একশো দিনের কাজ একশো দিনই হয়েছে। এতবড় মিথ্যাচার যারা করে তাদের সঙ্গে মানুষ বেশিদিন থাকবেন না। পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করেছে।”
তবে তৃণমূলের বক্তব্য, জেতা-হারা পরের কথা এ বার জঙ্গলমহলে যে সব আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছে, তাতেই খুশি তারা। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কয়েকটি আসন দখলও করছে শাসকদল। বেলপাহাড়ির বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা সুব্রত ভট্টাচার্য কিংবা ঝাড়খণ্ড পার্টির (নরেন) নেত্রী চুনিবালা হাঁসদাও মানছেন, “সিপিএমের প্রতি এখনও মানুষের মনে বিতৃষ্ণা রয়েছে।” ভোটের ময়দানে যা যাবে তৃণমূলের পক্ষে। কাঁটা শুধু গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। মুকুল-শুভেন্দুর গোষ্ঠী ও উপগোষ্ঠীর একাধিক নির্দল প্রার্থী রয়েছেন লড়াইয়ের ময়দানে। সেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে শাসকদলের মন্ত্রী সুকুমার হাঁসদা জোর দিয়ে বলেন বলেন, “উন্নয়ন ও শান্তির প্রশ্নে মানুষ আমাদের ভোট দেবেন।”
হাত ধরাধরির খেলায় তৃণমূল কতটা সুবিধা করতে পারল জঙ্গলমহলে, বলবে সময়। |
|
|
|
|
|