তৎক্ষণাৎ বাতিল হবে পদ
শাস্তিপ্রাপ্ত সাংসদ-বিধায়কদের রক্ষাকবচ কাড়ল কোর্ট
চ্চ আদালতে মামলা চলছে, এই যুক্তিতে নিম্ন আদালতে সাজাপ্রাপ্ত কোনও জনপ্রতিনিধি সংসদ বা বিধানসভার সদস্যপদ টিকিয়ে রাখতে পারেন না বলে জানিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট। আজ এক ঐতিহাসিক রায়ে শীর্ষ আদালত বলেছে, জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের এই সংক্রান্ত ৮(৪) ধারাটি সংবিধানসম্মত নয়। নিম্ন আদালতে দু’বছর বা তার বেশি মেয়াদের জন্য সাজা পেলেই সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধির সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায় নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই সাবধানী রাজনৈতিক নেতারা। রায় ভাল ভাবে খতিয়ে না-দেখে কোনও মন্তব্য করতে চাইছে না শাসক-বিরোধী, কোনও পক্ষই। কিন্তু রাজনীতিকে অপরাধমুক্ত করার দাবি নিয়ে যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁরা সকলেই এই রায়কে খোলা গলায় স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ এ দেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটা মাইল ফলক হয়ে থাকবে।
১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৮(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ফৌজদারি অপরাধে দু’বছরের বেশি কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কোনও ব্যক্তি সাজা ঘোষণার দিন থেকেই জনপ্রতিনিধি হওয়ার অধিকার হারাবেন। এবং মুক্তির পর ছ’বছর পর্যন্ত ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না। কিন্তু ওই আইনেরই ৮(৪) ধারায় বলা হয়েছে, সাজা ঘোষণার সময় যদি কেউ জনপ্রতিনিধি থাকেন, তা হলে পরবর্তী তিন মাস বা উচ্চতর আদালতে সাজা পুনর্বিবেচনার আবেদনের নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত তাঁর সদস্যপদ খারিজ হবে না।
জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের এই ৮(৪) ধারার বিরুদ্ধেই সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলেন লিলি টমাস এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা লোক প্রহরীর পক্ষে সম্পাদক এস এন শুক্ল। বিচারপতি এ কে পট্টনায়ক এবং বিচারপতি এস জে মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ আজ তার রায়ে বলেছে, “প্রশ্ন হল, জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৮(৪) ধারা সাংবিধানসম্মত (vires) কিনা। আমাদের মতে এটা অসাংবিধানিক (ultra vires) এবং সাজা ঘোষণার দিন থেকেই সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাওয়া উচিত।” সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য এ-ও বলেছে যে, নিম্ন আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়া যে সব সাংসদ-বিধায়ক ইতিমধ্যেই উচ্চ আদালতে আবেদন করেছেন, তাঁরা এই রায়ের আওতায় আসবেন না।
সাজার ফাঁদে
জনপ্রতিনিধিত্ব আইন
ধারা ৮(৩): কোনও ব্যক্তি ফৌজদারি অপরাধের জন্য ন্যূনতম ২ বছর সাজা পেলে শাস্তি ঘোষণার দিন থেকেই জনপ্রতিনিধি হওয়ার অধিকার হারাবেন এবং মুক্তি পাওয়ার পর ছ’বছর জনপ্রতিনিধি হতে পারবেন না। ধারা ৮(৪): সাজা ঘোষণার দিন যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সংসদ বা বিধানসভার সদস্য থাকেন, তা হলে পরবর্তী তিন মাস অথবা উচ্চতর আদালতে পুনর্বিবেচনার আবেদনের নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত তাঁর সদস্যপদ খারিজ হবে না।

প্রশ্ন হল, জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৮(৪) ধারা সাংবিধান সম্মত (vires) কিনা। আমাদের মতে, এটা অসাংবিধানিক (ultra vires) এবং সাজা ঘোষণার দিন থেকেই সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাওয়া উচিত। বিচারপতি এ কে পট্টনায়ক ও বিচারপতি এস জে মুখোপাধ্যায়।
সামাজিক অধিকাররক্ষা আন্দোলনকারীদের মতে, রাজনীতির অলিন্দে যে অন্ধকার কোণটা ছিল, সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের ফলে সেখানে আলো পৌঁছনোর সম্ভাবনা তৈরি হল। যা নিয়ে এত দিন ধরে টালবাহানা করছিলেন রাজনীতিকরা। নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। শুধু ভাল ভাল কিছু কথা হয়েছে। সামাজিক আন্দোলনকারীদের অনেকেরই অভিযোগ, জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে ফাঁকের সুযোগ নিয়েই নিম্ন আদালতে সাজা পেয়েও বিহারে পাপ্পু যাদব, সাহাবুদ্দিন বা উত্তরপ্রদেশে রাজা ভাইয়ার মতো ‘বাহুবলী’ রাজনীতিকরা বহাল তবিয়তে আইনসভার সদস্য থেকে গিয়েছেন।
রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন যে একটা বড় সমস্যা, সেটা কিন্তু স্বীকার করে প্রায় সব দলই। সংসদে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গত দু’টি লোকসভা ভোটের আগে অপরাধীদের প্রার্থী না-করার ব্যাপারে সর্বদল বৈঠকও হয়েছে। তবু ছবিটা পাল্টায়নি। অ্যাসোসিয়েশন অফ ডেমোক্র্যাটিক রিফর্ম-এর (এডিআর) সমীক্ষা বলছে, বর্তমানে ১৬৩ জন সাংসদ এবং ১৪৬০ জন বিধায়কের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে। এঁদের মধ্যে ৭৬ জন সাংসদ এবং ৬১৪ জন বিধায়কের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। অপরাধ প্রমাণিত হলে এই জনপ্রতিনিধিদের অন্তত ৩০ শতাংশের পাঁচ বছর বা তার বেশি কারাদণ্ড হতে পারে।
সুপ্রিম কোর্টের আজকের রায় স্বাভাবিক ভাবেই ভাবিয়ে তুলেছে রাজনৈতিক দলগুলিকে। তবে প্রকাশ্যে এই রায়ের বিরুদ্ধে কোনও মন্তব্য তারা করেনি। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কপিল সিব্বল বলেন, “আদালতের রায় ইতিবাচক। তবে রায়টি বিশদে পড়ে তবেই সরকার এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবে।” অন্য দিকে বিজেপি মুখপাত্র তথা বিশিষ্ট আইনজীবী রবিশঙ্কর প্রসাদের বক্তব্য, “বিজেপি বরাবরই রাজনীতিতে স্বচ্ছতার পক্ষে। তবে রায়টি সামগ্রিক ভাবে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। কারণ এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে চলেছে।” ব্যতিক্রম অবশ্য তৃণমূল। রায়ের কপি হাতে পাননি জানিয়েও তৃণমূলের আইনজীবী সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “যদি সুপ্রিম কোর্ট এ ধরনের রায় দেয়, তা হলে তা আমাদের দেশের গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। এই ধরনের নির্দেশ দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের এক্তিয়ার বহির্ভূত। তারা কোনও আইন তৈরি করতে পারে না।”
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বিশেষ করে আঞ্চলিক দলগুলিই বিপাকে পড়বে। কারণ, ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্তের সংখ্যা আঞ্চলিক দলে শুধু তুলনামূলক ভাবে বেশিই নয়, এঁদের দাপটের উপরে দলের রাজনৈতিক প্রতিপত্তিও অনেকাংশে নির্ভরশীল। কংগ্রেসের এক নেতা আবার বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্য আদালতের এই রায়ের অপব্যবহারের আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে বিরোধী পক্ষকে বিপদে ফেলার প্রয়াস এর পর বাড়তে পারে। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম যেমন বলেছেন, “রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন বন্ধে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ সদর্থক হতে পারে। কিন্তু এমন নির্দেশ অপব্যবহারের সুযোগও রয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে যে ভাবে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের একের পর এক মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে, তাতে এই আশঙ্কা থেকেই যায়।”
কেন জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে বর্তমান সাংসদ-বিধায়কদের ওই ছাড় দেওয়া হয়েছিল তার ব্যাখ্যা দিয়ে সরকার পক্ষের আইনজীবী অতিরিক্ত সলিসিটার জেনারেল সিদ্ধার্থ লুথরা আদালতে বলেছিলেন, সাংসদ বা বিধায়ক সংখ্যা আচমকা কমে গেলে সরকারের স্থায়িত্ব সঙ্কটে পড়তে পারে। সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা খাদের কিনারায় পৌঁছে গেলে দেশে অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কাও রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আইনসভার কোনও সদস্যের সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাওয়ার পর ৬ মাসের মধ্যে তাঁর কেন্দ্রে ভোট করাতে হয়। কিন্তু ছ’মাসের মধ্যে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি উচ্চ আদালত থেকে নির্দোষ বলে মুক্তি পান, তা হলে উপনির্বাচনের সমস্ত প্রক্রিয়া জলে যাবে। তৃতীয়ত, নিম্ন আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলেও উচ্চ আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার হার এ দেশে অনেক বেশি।
তবে আদালত সরকার পক্ষের এই সব যুক্তি শুনতে চায়নি। বরং বিচারপতিদের মতে, কোনও ব্যক্তির আইনসভার সদস্য থাকার যোগ্যতা রয়েছে কিনা, তার ব্যাখ্যা সংবিধানের ১০২(১)(ই) এবং ১৯১(১)(ই) ধারায় রয়েছে। আদালত তাই আর অন্য কোনও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যেতে চাইছে না। এই মামলার জন্য যেটুকু প্রয়োজন, সেটাই বিবেচনা করছে।
কিছু দিন আগেই রাজনৈতিক দলগুলিকে তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। গত সপ্তাহে তারা নির্বাচনী ইস্তাহারে গালভরা প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তার পরেই আজকের এই রায়।
আদালতের এই সক্রিয়তায় শঙ্কিত নেতাদের অনেকের মতে, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দুর্বল হওয়াই এর কারণ। কিন্তু সাধারণ মানুষের আকাঙ্খার প্রতিফলনের দিকটাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকে। তাঁদের মতে, মানুষের প্রত্যাশা পূরণে রাজনীতিকরা যখন ব্যর্থ হচ্ছেন, তখন দিশা দেখাচ্ছে আদালতই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.