ছাত্রছাত্রীদের হাতে বই পৌঁছতে ইতিমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। সরকারি আইনজীবী হাইকোর্টে সে কথা বলতেই বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় ধমক দিলেন, “সংসদ যখন বেআইনি কাজ করছিল, তখন সরকার কী করছিল?”
একাদশ শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার বরাত ঘিরে এ বার কেলেঙ্কারির অভিযোগ উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের বিরুদ্ধে। যার জেরে আটটি বিষয়ের বই ছাপা ও বিক্রির বিরুদ্ধে মঙ্গলবার অন্তর্বর্তিকালীন স্থগিতাদেশ জারি করল কলকাতা হাইকোর্ট। এ দিন একটি প্রকাশনা সংস্থার তরফে দায়ের করা মামলাটি হাইকোর্টে ওঠে। বিচারপতি বলেন, ১১ জুলাই, বৃহস্পতিবার তিনি সব পক্ষের বক্তব্য শুনে রায় দেবেন। তার আগে বইগুলি প্রকাশ বা বিক্রি করা যাবে না।
এ দিন আদালতের বক্তব্য শোনার পরে সংসদ সভাপতি মুক্তিনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ডেকে পাঠান শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। ছাপার বরাত নিয়ে অনিয়মের অভিযোগের তির ঘটনাচক্রে মুক্তিনাথবাবুর দিকেই। তিনি অবশ্য এ নিয়ে এ দিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি। শুধু জানান, শিক্ষামন্ত্রী আদালতের রায়টি ভাল ভাবে দেখতে বলেছেন। তবে ছাত্রছাত্রীদের হাতে বই পৌঁছতে যে আরও কিছুটা দেরি হবে, তা মেনে নেন তিনি। ব্রাত্যবাবু পরে বলেন, “সভাপতিকে বলেছি, সমস্যার নিষ্পত্তি সংসদকেই করতে হবে। সরকার চায়, ছেলেমেয়েদের বই পেতে যেন দেরি না হয়। আইনি পরামর্শ নিয়ে সমস্যার সমাধান করতে বলেছি সভাপতিকে। উনিও জানিয়েছেন, আইনি পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে।” তবে বাজারে বই বিক্রি বন্ধ থাকার ব্যাপারে তিনি মন্তব্য করতে চাননি। মন্ত্রী বলেন, “আদালতের রায় না দেখে কিছু বলব না।”
এমনিতে একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে জুনের চতুর্থ সপ্তাহেই। অথচ প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ পড়ুয়ার হাতে এখনও বাংলা, ইংরেজি-সহ আটটি বিষয়ের পাঠ্যবই আসেনি। এর জেরে পড়ুয়াদের পঠনপাঠন ইতিমধ্যে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবশেষে মঙ্গলবার বই বাজারে এসেছিল। এ দিন কলেজ স্ট্রিটের দোকানে বাংলা ও ইংরেজি পাঠ্যবই কিছু বিক্রিও হয়। বিক্রেতাদের কারও কারও বক্তব্য, “আমরা এত টাকা খরচ করে বই কিনেছি। কী করে ফেলে রাখব!” যদিও বিক্রেতাদের একাংশ এ কথাও বলছেন, হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকলে বুধবার থেকে বই বিক্রি করা কঠিন হবে। কারণ সে ক্ষেত্রে আদালত অবমাননা করার দায়ে পড়তে হতে পারে। বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ানোয় ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদেরও দুশ্চিন্তা বেড়েছে। দক্ষিণ কলকাতার এক সরকারি স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা বলেন, “এমনিতেই একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির জন্য যথেষ্ট ক্লাস পাওয়া যায় না। তার উপরে এ বারে বই হাতে না পাওয়ায় সমস্যাটা আরও কঠিন হল।”
উচ্চ মাধ্যমিকের বই ছাপা নিয়ে বিতর্ক অবশ্য শুরু হয়েছে কয়েক মাস আগে থেকেই। যে পদ্ধতিতে বরাত দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে মে মাসেই স্কুলশিক্ষা দফতরে চিঠি পাঠান সংসদের সচিব অচিন্ত্য পাল। তার ভিত্তিতে পর্যবেক্ষক দল গড়ে বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর শুরু হয় দফতরের তরফে। এই প্রশাসনিক চাপানউতোরের মধ্যেই পাঠ্যবই ছাপা ও বাজারে পৌঁছনোর কাজটি ক্রমাগত পিছিয়ে যেতে থাকে। দফতর সূত্রের খবর, সরকারি নীতি ছিল, সংসদের আর্থিক ক্ষতি করে কোনও সংস্থাকে বই ছাপার বরাত দেওয়া যাবে না। কিন্তু তার পরেও সর্বোচ্চ দর-দাতা সংস্থাকে বাদ দিয়ে অন্য সংস্থাকে বরাত দেওয়া হয়েছে এবং তাতে সংসদের প্রায় পাঁচ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে বলে অভিযোগ।
এত দিন সংসদের বাংলা, ইংরেজি পাঠ্যবই বই ছাপত বিশ্বভারতী। কিন্তু এ বছর নতুন পাঠ্যক্রম শুরু করার পাশাপাশি বই ছাপার ব্যবস্থাপনায় বদল আনার সিদ্ধান্ত নেয় সংসদ। আগের পাঠ্যক্রম অনুযায়ী ছাপা, অবিক্রীত বই বাবদ তাই সংসদের কাছে আড়াই কোটি টাকা দাবিও করেছে বিশ্বভারতী। ইংরেজি, বাংলা-সহ মোট আটটি বিষয়ের বই এ বার সংসদ নিজে ছাপার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু একটি প্রকাশনা সংস্থা হাইকোর্টে সংসদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছে। তাদের বক্তব্য, সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ রয়্যালটি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও অধিকাংশ বই ছাপানোর বরাত দেওয়া হয় হায়দরাবাদের একটি সংস্থাকে। তারা মাত্র ২৫ শতাংশ রয়্যালটি দেবে বলেছিল বলে অভিযোগ।
এই বিষয়টিই শিক্ষা দফতরের গোচরে এনেছিলেন সংসদ সচিব অচিন্ত্যবাবু। তার পরে পর্যবেক্ষক কমিটি গড়ে একটা রফা সূত্রে পৌঁছনোর চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু সেটাও কাজে আসেনি। আবেদনকারীর আইনজীবী এ দিন বলেন, সর্বোচ্চ দর দেওয়া সত্ত্বেও কেন তাঁর মক্কেলকে বাদ দেওয়া হল, তার ব্যাখ্যা সংসদ দেয়নি। তাই বাধ্য হয়েই তাঁরা হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়েছেন। সচিব অচিন্ত্যবাবু ব্যক্তিগত কারণে দিল্লিতে রয়েছেন। সেখান থেকে টেলিফোনে তিনি বলেন, “আমার যা বলার আগেই জানিয়েছি। তবে দেখা গেল, নিয়ম সকলের জন্যই এক। কোনও বিশেষ ব্যক্তির জন্য তা বদলায় না।”
সংসদের আধিকারিকদের একাংশ দাবি করছেন, বই ছাপার বরাত যে নির্দিষ্ট একটি সংস্থাকেই দেওয়া হবে, দরপত্র চাওয়ার আগেই তা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কী ভাবে তা বোঝা গেল? ওই আধিকারিকদের দাবি, দরপত্র ডাকা হয় এপ্রিলে। আর বাজারে যে বই বিক্রি হচ্ছে, সভাপতি তার মুখবন্ধ লিখেছেন মার্চ মাসে। এর থেকেই ওই সংস্থার প্রতি সংসদ কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট হয় বলে তাঁরা ঘনিষ্ঠ মহলে অভিযোগ করছেন। এক আধিকারিক বলেন, “প্রকাশনার বরাত দেওয়ার ব্যাপারে না জড়াতে বলে সতর্ক করা হয়েছিল সভাপতিকে। কিন্তু উনি কথা কানে তুললেন না।”
পাঠ্যবই নিয়ে এই জাতীয় কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠায় সংসদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে বলে মনে করছেন অনেকেই। সংসদ যদিও স্বশাসিত সংস্থা, কিন্তু সার্বিক ভাবে শিক্ষা-পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাওয়ায় তার দায় সরকারের উপরেও খানিকটা এসে পড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ দিন সরকারি আইনজীবীর বক্তব্যের নিরিখে বিচারপতি ‘সরকার কী করছিল’, এই প্রশ্নও তুলেছেন। শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে সরকার যথোপযুক্ত জায়গায় কিছু বিকল্প প্রস্তাব দেওয়ার কথাও ভাবছে। প্রয়োজনে রয়্যালটির তোয়াক্কা না করে পাঠ্যবস্তু পুরোটাই ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়ার ভাবনাও সরকারের রয়েছে। যে কোনও প্রকাশকই সেখান থেকে বই ছাপতে পারবেন, পড়ুয়ারাও দ্রুত বই পাবেন। কিন্তু বিষয়টি এই মুহূর্তে যেহেতু বিচারাধীন, তাই সব কিছুই আপাতত আদালতের বিবেচনার উপরে নির্ভর করছে।
|
(বই পৌঁছতে দেরি প্রসঙ্গে) সংসদ যখন বেআইনি
কাজ করছিল, তখন সরকার কী করছিল?
বিচারপতি
সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় |
ছাত্রছাত্রীদের হাতে বই পৌঁছতে হয়তো আরও কিছুটা দেরি হবে। দেখা যাক।
মুক্তিনাথ চট্টোপাধ্যায় সভাপতি
উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ |
সংসদ সভাপতিকে বলেছি, সমস্যার নিষ্পত্তি সংসদকেই করতে হবে।
সরকার চায়, ছেলেমেয়েদের বই পেতে যেন দেরি না হয়।
ব্রাত্য বসু
শিক্ষামন্ত্রী |
|