বুদ্ধগয়ার বোধিমন্দিরে পর-পর দশটি বিস্ফোরণে দেশবাসী সচকিত। বৌদ্ধ ধর্মস্থানে এ ধরনের সন্ত্রাসবাদী হামলা এ দেশে এই প্রথম, সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বিরল। অতীতে এক ধর্মাবলম্বীদের সহিত অন্য ধর্মাবলম্বীদের সংঘাত ও বিরোধের ইতিহাসে হিংসা ও রক্তপাতের ঘটনা ভূরি ভূরি। কিন্তু সেখানে সাম্রাজ্যবিস্তারের স্বার্থই মুখ্য থাকিয়াছে। বিজয়ী রাজশক্তি বিজিতের ধর্মস্থানকে ধূলিসাৎ করিয়াছে। কাপুরুষোচিত সন্ত্রাসবাদী হামলার সেখানে কোনও স্থান ছিল না। বোধিমন্দিরের হামলায় পার্থিব ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তত বেশি নয়, কিন্তু বুদ্ধের অহিংসার ধর্ম ও সেই ধর্মাবলম্বীদের মনে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হইল, তাহা অনপনেয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় ইহাই যে, সেই ক্ষতে প্রলেপ দিবার পরিবর্তে দেশের রাজনীতিকরা নানা ভাবে এই হামলার ঘটনা লইয়া সংকীর্ণ, স্বার্থান্বেষী রাজনীতি অনুশীলন করিতেছেন।
বুদ্ধগয়ার এই হামলায় যে রাজ্য সরকারের নিরাপত্তা-ব্যবস্থার শৈথিল্য উদ্ঘাটিত হইয়া পড়ে, তাহাতে সংশয় নাই। বোধিমন্দির ও সংলগ্ন বোধিবৃক্ষের (যাহার তলে বসিয়া গৌতম বুদ্ধ তপস্যায় বোধিলাভ করেন বলিয়া অনুগামীদের বিশ্বাস) চারিপাশে যে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় পূর্ব হইতেই মোতায়েন থাকা জরুরি ছিল, তাহা থাকে নাই। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক যখন হামলার শঙ্কা বিষয়ে রাজ্যকে আগাম সতর্ক করিয়াছিল, তখন নিবারক নিরাপত্তা-বন্দোবস্ত কেন রাখা হয় নাই? এই প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের যে-সমালোচনা বিরোধীরা করিতেছেন, তাহা অতএব পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, সন্ত্রাসবাদী হামলার পূর্ণাঙ্গ ছক আগাম জানা না-থাকিলে তাহার নিবারণ একপ্রকার অসম্ভব। আমেরিকা-ব্রিটেন যাহা পারে না, ভারত তাহা পারিবে কেমন করিয়া? এবং সন্ত্রাসবাদীরা কার্যত যে-কোনও স্থানেই যখন খুশি আক্রমণ করিতে পারে। সম্ভবত সে কথা উপলব্ধি করিয়াই বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই নীতীশ কুমার-বিরোধী কামানগর্জন মোলায়েম করিয়া আনেন এবং সন্ত্রাস দমনে সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এনডিএ ত্যাগ এবং বিহারে জোট-সহযোগী বিজেপির সঙ্গত্যাগের অপমান যে বিজেপি সহজে হজম করে নাই, অরুণ জেটলি এবং সুশীল মোদীর বাক্যবাণে তাহার পর্যাপ্ত ইঙ্গিত ছিল। একই রকম ক্রুদ্ধ লালুপ্রসাদ যাদবও, এনডিএ-ত্যাগী নীতীশ কুমারকে সঙ্গে পাইবার লোভে কংগ্রেস যাঁহাকে ঝাড়খণ্ডে ও বিহারে উপেক্ষা করিতে শুরু করিয়াছে। কংগ্রেসের নেতা দিগ্বিজয় সিংহের ‘টুইট’ পড়িলে অবশ্য মনে হইবে, নরেন্দ্র মোদী বিহার বিজেপির স্বেচ্ছাসেবকদের নীতীশ কুমারকে শিক্ষা দিবার কথা বলার পর দিনই বোধিমন্দিরে এই সন্ত্রাসবাদী হামলা মোটেই কাকতালীয় নয়। দিগ্বিজয় সিংহের কল্পনাশক্তি বরাবরই উর্বর। কিন্তু তাঁহার প্রগল্ভতাকে লাগাম পরাইবার দায়িত্ব দলীয় হাইকমান্ডেরই।
ভারতের নানা স্থানে বহু বৌদ্ধ মন্দির, মঠ, বিহার, স্মারক ছড়াইয়া আছে। সেগুলিকে সযত্ন রক্ষা করা জাতীয় কর্তব্য। দেশে আজ পর্যাপ্তসংখ্যক বৌদ্ধ নাই বলিয়াই এই সব ঐতিহাসিক স্মারক অবহেলিত বা অরক্ষিত থাকিবে, ইহা অভিপ্রেত নয়। কেন্দ্র, রাজ্য সরকারগুলিকে এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আরও যত্নবান হইতে হইবে। কাহারা বোধিমন্দিরে বিস্ফোরণ ঘটাইয়াছে, তাহা লইয়াও সংকীর্ণ রাজনীতি চলিতেছে। কোনও প্রমাণ ছাড়াই ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন-এর মতো জেহাদি মুসলিম সংগঠনকে দায়ী করা হইতেছে। তত্ত্ব হিসাবে খাড়া করা হইতেছে মায়ানমারে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের হাতে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিগ্রহের প্রতিহিংসাকে। দেশের প্রায় সকল মুসলিম সংগঠন ও দল কিন্তু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই হামলার নিন্দা করিয়াছে। সন্ত্রাসবাদের সহিত যে ইসলাম বা অন্য কোনও ধর্মের সম্পর্ক নাই, সন্ত্রাসীরা যে হিন্দু, শিখ, মুসলিম, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান কিছুই নয়, নিছকই সন্ত্রাসবাদী, যাহারা নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা করিয়া দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চায়, এই সত্যটি উপলব্ধি করার আহ্বান জানাইয়াছে। কিন্তু এ দেশে যেমন সন্ত্রাসে অভিযুক্ত মুসলিম তরুণদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করিয়া সংখ্যালঘু তোষণ করা হয়, তেমনই যে কোনও জঙ্গি সন্ত্রাসকে মুসলিমদের অপকর্ম রূপে প্রচার করিয়াও নির্বাচনী বৈতরণী পার হইবার চেষ্টা চলে। ইহা গভীর আশঙ্কার কারণ। |