পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, দেখা যাইতেছে, সত্যই থামিতে জানেন না। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সহিত তাঁহার দ্বৈরথ, সুপ্রিম কোর্টে গড়াইবার পূর্বেই, কুশ্রী আকার লইয়াছিল। মুখ্যমন্ত্রীর অজ্ঞাতসারে বা অনিচ্ছায় নহে নিশ্চয়ই। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মুখ্যমন্ত্রীর কার্যত পরাজয় ঘটিয়াছে। তিনি তাহার পরেও থামেন নাই। বিভিন্ন জনসভায় তিনি কমিশনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করিতেছেন। তাহাতে রাজনৈতিক লাভ নিশ্চয়ই হইতেছে সেই হিসাব কষিতে তৃণমূলনেত্রী সচরাচর ভুল করেন না। কিন্তু, কমিশনের বিরুদ্ধে তাঁহার এই অবান্তর জেহাদ তাঁহার পদের মর্যাদাকে ধুলায় মিশাইতেছে। মুখ্যমন্ত্রী যে ভাষায়, যে ভঙ্গিতে কমিশনের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাইতেছেন, তাহা এক জন মুখ্যমন্ত্রীর নিকট অপ্রত্যাশিত। কিন্তু তাহা গৌণ। মমতাদেবী যখন দলীয় মঞ্চ হইতেও বক্তৃতা করেন, তখনও তাঁহার প্রধানতম পরিচয়, তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একটি সাংবিধানিক শীর্ষ আসনের অধিকারী। রাজ্য নির্বাচন কমিশনও একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। মুখ্যমন্ত্রী হইয়া, নিতান্তই কিছু সংকীর্ণ নির্বাচনী মুনাফার খাতিরে, তিনি নির্বাচন কমিশনের সহিত এই অবান্তর সংঘাতে জড়াইয়া যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করিতেছেন, তাহার দাগ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অনপনেয় হইবে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, মমতাদেবী পথপ্রদর্শক নহেন এই ক্ষেত্রেও তিনি বামপন্থীদের অনুসারীমাত্র। কিন্তু জ্যোতি বসু টি এন শেষনের প্রতি গালিবর্ষণের যে কু-দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহার উত্তরাধিকার বহন করিবার বাধ্যতা তো মমতাদেবীর নাই। মহাকালের খাতায় ব্যক্তি জ্যোতি বসু থাকিবেন না, ব্যক্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নহেন কিন্তু তাঁহাদের আচরণের নিদর্শন থাকিয়া যাইবে, ‘যোগ্যতর উত্তরাধিকারী’র অপেক্ষায়। ভবিষ্যতের আচরণ আরও এক ধাপ নামিয়া যাইবে, অনন্ত পাতালের দিকে। মুখ্যমন্ত্রী কি এখনও থামিবেন না?
ভারতীয় গণতন্ত্র তাহার শত খামতি সত্ত্বেও দুনিয়ায় স্বতন্ত্র তাহার প্রতিষ্ঠানগুলির সবলতার কারণেই। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে মমতাদেবীর বিষোদ্গার, সেই অর্থে, গণতন্ত্রের উপর আঘাত। তিনি যতই ‘গণতন্ত্রের মাধ্যমে’ নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ‘বদলা’ লইবার কথা বলুন, তাহা আসলে গণতন্ত্রের ক্ষুদ্র সংজ্ঞা রাজনীতিকরা যে খণ্ডিত অর্থে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করিয়া থাকেন। গণতন্ত্রের প্রতি তাঁহার দায়বদ্ধতা থাকিলে তিনি সংযত হইতেন। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং তাঁহার দলের নাম তৃণমূল কংগ্রেস বলিয়াই আরও বেশি সংযম প্রয়োজনীয় ছিল। তাঁহার দলে তাঁহার কথাই আইন তাঁহার আচরণ হইতেই নেতা-কর্মীরা তাঁহাদের কর্তব্য বুঝিয়া লন। তাঁহার বিষোদ্গারে অন্যান্য নেতারা বুঝিয়াছেন, ইহাই ‘কর্তব্য’ মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ তারসপ্তকে চলিলে অতিতারসপ্তকে কমিশনের আদ্যশ্রাদ্ধ না করিলেই বুঝি নম্বর কাটা যাইবে। ফলে মদন মিত্র হইতে ছোট-বড় স্থানীয় নেতা, প্রত্যেকেই পথে নামিয়াছেন। তাঁহারা যে ভাষায় কথা বলিতেছেন, তাহা গণতন্ত্রের অযোগ্য। মুখ্যমন্ত্রী পথ দেখাইয়াছেন, অনুগামীরা অনুসরণ করিতেছেন। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাজনীতির সংকীর্ণ খেলার নূতন অধ্যায় রচিত হইতেছে। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা এবং আস্থা থাকিলে মুখ্যমন্ত্রী সংযত হইতে পারিতেন।
তাঁহার নিকট সে প্রত্যাশা অবশ্য অর্থহীন। যখন বিরোধী ছিলেন, এবং যখন শাসক হইয়াছেন, কোনও পর্বেই গণতন্ত্রের মূল শর্ত, অর্থাত্ আলোচনার মাধ্যমে শাসনের প্রতি তাঁহার আস্থা ছিল না, নাই। বিরোধী-পর্বেও তিনি সর্বদল বৈঠকে যাইতেন না, শাসক পর্বেও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ডাকা বৈঠকে তাঁহার দল অনুপস্থিত। আলোচনার পরিসরটিকে সম্পূর্ণ এড়াইয়া যাইবার প্রবণতা তাঁহার বিরোধী-অবতারে বিপজ্জনক ছিল। কিন্তু, রাজ্যের শাসক দল হিসাবে এই আচরণ অক্ষমণীয়। নির্বাচনী জনসভা গণতন্ত্র-চর্চার প্রকৃষ্ট পরিসর নহে তাহাতে গলার জোরই মুখ্য, যুক্তির ধার নহে। মুখ্যমন্ত্রীকে বুঝিতে হইবে, একটি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে তিনি আলোচনার পরিসরটিকে অবজ্ঞা করিতে পারেন না। তাঁহাকে সেই পরিসরে নিজের কথা বলিতে হইবে, অন্যের কথা শুনিতে হইবে। একমাত্র সেই পরিসরেই যে কোনও সমস্যার যথার্থ গণতান্ত্রিক সমাধান প্রয়োজন। পঞ্চায়েতের পরীক্ষা আর গণতন্ত্রের পরীক্ষা এক নহে। |