ঘরভর্তি দামি আসবাবপত্র, আলমারিতে গয়না। ফ্ল্যাট বা বাড়ি সামলাচ্ছেন এক বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা। অশক্ত ওই মানুষটিকে কাবু করতে পারলেই কব্জা করা সম্ভব মূল্যবান জিনিসপত্র।
কখনও রঙের মিস্ত্রি, কখনও কল সারানোর মিস্ত্রি, কোথাও বা বাড়ির পরিচারক হিসাবে কাজে ঢুকে এই সুযোগ নিয়ে লুঠপাট চালাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। তিলজলার অলোক রায়, মানিকতলার বিধান আবাসনের শান্তা ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে একের পর এক ডাকাতি ও খুনের ঘটনার তদন্ত করে গোয়েন্দাদের ধারণা, দুর্বল বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সহজে কাবু করে লুঠপাট করাই ছিল দুষ্কৃতীদের লক্ষ্য।
দুষ্কৃতীদের এই ‘সফ্ট টার্গেট’-দের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য কী ভাবছেন পুলিশকর্তারা? লালবাজারের কর্তাদের বক্তব্য, থানাগুলির যা পরিকাঠামো, তাতে এ ধরনের মানুষদের আলাদা করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা কার্যত অসম্ভব। কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “পুলিশের একার পক্ষে এ ধরনের অপরাধ আটকানো সম্ভব নয়। প্রয়োজন প্রতিবেশীদের সাহায্যও। নিরাপত্তার ব্যাপারে আরও সচেতন হওয়া দরকার একলা থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদেরও।”
কী রকম?
পুলিশের এক কর্তা বলেন, “আমরা সকলের কাছে আবেদন করি, বাড়িতে পরিচারক-পরিচারিকা নিয়োগ করার আগে তাঁর বিস্তারিত তথ্য স্থানীয় থানার হাতে তুলে দেওয়া উচিত।” পুলিশের দাবি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটা মানা হয় না। সব বড় আবাসনে সিসিটিভি বসানোর কথা বলা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা করা সম্ভব হয়নি বলেও লালবাজার সূত্রে খবর।
তদন্তকারীদের দাবি, ২০০৮ সালে গড়িয়াহাটের আবাসনে পরিচারকের হাতে খুন হন ঊষা চোখানি। তদন্ত নেমে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, ওই পরিচারকের কোনও পরিচয়পত্র-ই রাখা হয়নি। তদন্তকারীদের একই অবস্থা হয়, ২০১১ সালে মানিকতলার বিধান আবাসনে ৯০ বছরের শান্তা ভট্টাচার্য খুনের পরেও। ওই আবাসনে কাজ করছিলেন রঙমিস্ত্রিরা। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তাঁদের কোনও পরিচয়পত্র রাখেননি কেউ। ফলে দুষ্কৃতীদের ধরতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল পুলিশের।
তদন্তকারী অফিসারদের বক্তব্য, যে সব বৃ্দ্ধরা একা বাড়িতে থাকেন, তাঁদের ফ্ল্যাট বা বাড়ির সদর দরজা খোলার ব্যাপারে সাবধান হওয়া উচিত। বিশেষ প্রয়োজনে অপরিচিত কোনও ব্যক্তিকে বাড়িতে ঢোকাতে হলে প্রতিবেশীদের কাউকে ডেকে নেওয়া উচিত বলে জানিয়েছেন পুলিশকর্তারা।
নাগরিকদের সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি, পুলিশ অবশ্য বয়স্কদের সাহায্যের জন্য প্রণাম নামের একটি প্রকল্প চালু করেছে। ২০০৮ সালে প্রথমে লেক থানায় ওই প্রকল্পটি চালু হয়। এর পরে ২০০৯ সালে কলকাতা পুলিশ ওই প্রকল্প শহরের বাকি সব থানাতেই চালু করে। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (৩) দেবাশিস রায় বলেন, “আমরা মূলত অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সহায়তার জন্যই ওই প্রকল্প চালু করেছি।”
পুলিশ জানায়, প্রথমে প্রণাম প্রকল্পের সদস্য হতে হবে বৃদ্ধদের। তাঁরা কোনও বিপদে পড়লে ফোন করলেই পুলিশি সাহায্য মিলবে। এর জন্য তাঁদের আর পুলিশকে নিজের বাড়ির ঠিকানা বা অন্য তথ্য জানাতে হবে না। শুধু নাম বললেই পুলিশ তাঁর বাড়িতে পৌঁছে যাবে। এই প্রকল্পের জন্য কলকাতা পুলিশের প্রতিটি থানাতেই দু’জন করে অফিসারকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে লালবাজারের কর্তারা জানিয়েছেন। তাঁরা জানান, প্রণামের বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় ৮০০০-এর বেশি।
তবে প্রণাম প্রকল্প শহরের বয়স্কদের মধ্যে যে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়নি, তা মেনে নিয়েছেন লালবাজারের কতার্রা।
এক পুলিশকর্তা বলেন,“আগে ঘটা করে ওই প্রকল্পের কথা প্রচার করা হত,এখন সে কাজ বন্ধ। যেখানে সুলোচনা চারি খুন হয়েছেন, সেই কসবা থানাতেই এই প্রকল্পের সদস্য রয়েছেন মাত্র একশো জন। এ থেকে বোঝা যায় প্রণাম প্রকল্পের কী অবস্থা!”
|
তারিখ |
ঘটনা |
কোথায় |
মামলার কী অবস্থা |
৭ জুলাই ’১৩ |
বন্ধ ফ্ল্যাটে খুন সুলোচনা চারি (৬৯) |
কসবা |
গ্রেফতার হয়নি |
১০ জুন ’১৩ |
ঘরের মধ্যে খুন সুজিত চৌধুরী (৬২) |
পাটুলি |
গ্রেফতার হয়নি |
৬ সেপ্টেম্বর ’১২ |
গৌরী ভট্টাচার্য (৭০)-সহ চার জন খুন |
বেহালা |
গ্রেফতার চার |
২২অগস্ট ’১২ |
ডাকাতির পর খুন ফুলরেণু চৌধুরী (৬৮) |
চিৎপুর |
গ্রেফতার পাঁচ |
২৭ জুলাই ’১১ |
ডাকাতির পর খুন শান্তা ভট্টাচার্য (৯০) |
বিধান আবাসন, মানিকতলা |
গ্রেফতার চার |
১৪ এপ্রিল ’১১ |
খুন অলোক রায় (৫৫) ও তাঁর বোন সুচিত্রা রায় (৫২) |
তিলজলা |
গ্রেফতার চার |
২৬ ফেব্রুয়ারি ’১০ |
সুধাদেবী সিংহানিয়ার (৫৮) দেহ উদ্ধার |
কাঁকুড়গাছি |
গ্রেফতার এক |
১৮ ডিসেম্বর ’০৮ |
প্রতিবেশীর হাতে খুন নমিতা গুহ (৭৬ ) |
ফুলবাগান |
গ্রেফতার এক |
১৬ মার্চ ’০৮ |
পরিচারকের হাতে খুন ঊষা চোখানি (৫৪) |
গড়িয়াহাট |
গ্রেফতার এক |
৯ সেপ্টেম্বর ’০৭ |
খুন সবিতা বন্দ্যোপাধ্যায়(৬৬) |
শ্যামপুকুর স্ট্রিট |
গ্রেফতার দুই |
১৫ ফেব্রয়ারি ’০৭ |
পরিচারকের হাতে খুন রবীন্দ্র কৌর লুথরা (৫১) |
বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড |
খুনির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড |
সূত্র: কলকাতা পুলিশ |
|