|
|
|
|
ইতিহাসের পিছনে স্কিলের থেকেও ফিটনেস |
|
সেরা ফর্মের ফেডেরার,
সাম্প্রাসও থামাতে পারত না
জয়দীপ মুখোপাধ্যায় |
|
অ্যান্ডি মারে ৬-৪, ৭-৫, ৬-৪ জকোভিচকে হারিয়ে যাঁর সা-তা-ত্ত-র বছর বাদে প্রথম ব্রিটিশ হিসেবে উইম্বলডন পুরুষ সিঙ্গলস খেতাব জিতে নতুন ইতিহাস রচনা করল, সেই ফ্রেড পেরির মূর্তি সেন্টার কোর্টের বাইরে এখন প্রতিষ্ঠিত! ‘ফ্রেড পেরির ভূত’ কতটা আদিমকালের এতেই প্রমাণিত।
মারে যখন অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হয়নি। নিউইয়র্কে প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতেনি। সমগ্র ব্রিটিশ জাতি যখন ওকে ধীরে...খুব ধীরে নায়ক ভাবতে শুরু করেছে, সেই সময় মারে ওর প্রথম আত্মজীবনী লিখেছিল। ‘হিটিং ব্যাক’। মাত্র কুড়ি বছরে। যার প্রথমেই ও লিখেছিল, “আমি হারতে ভালবাসি না। কিপলিংয়ের মতো জয় আর হারকে একই মনোভাবে দেখি না।”
উইম্বলডন শুরুরও আগে মুম্বইয়ে (তখন নাম ছিল বম্বে) জন্মানো প্রসিদ্ধ ইংরেজ সাহিত্যিক রুডিয়ার্ড কিপলিং-এর ‘ইফ’ নামের কবিতার বিখ্যাত দুটো লাইন উইম্বলডন সেন্টার কোর্টে প্লেয়াররা যে গেট দিয়ে ঢোকে, তার ঠিক ওপরে বরাবর খোদাই করা। প্লেয়ারদের ওই লেখাটার তলা দিয়ে মাঠে ঢুকতে হয়। আমিও খেলার সময় ঢুকেছি। ‘ইফ ইউ ক্যান মিট উইথ ট্রাম্প অ্যান্ড ডিজাস্টার/ অ্যান্ড ট্রিট দোজ টু ইমপোস্টার্স জাস্ট দ্য সেম’। ব্রিটিশ কবির কবিতার পাশাপাশি ব্রিটিশ টেনিস-ইতিহাস গড়ার কারিগরের পাল্টা বক্তব্যও এ বার থেকে সেন্টার কোর্টে প্লেয়ারদের ঢোকার গেটের মাথায় খোদাই থাকলে অবাক হওয়ার নেই। |
মারেময় রবিবাসরীয়
সেন্টার কোর্টে। |
দুর্ধর্ষ স্কিলের পাশাপাশি অবাক করা ফিজিক্যাল ফিটনেসের জোরে মারে অনন্ত চাপের ফাইনাল বার করে নিল। জকোভিচের চেয়ে অন্তত চল্লিশ পার্সেন্টেজ বেশি কোর্টে আজ দৌড়েছে মারে। ম্যাচের পর ইন্টারনেটে দেখছিলাম, জকোভিচ দু’মাইল দৌড়েছে। মারে সাড়ে তিন মাইল। মারের অবিস্মরণীয় রিটার্ন মারার পিছনে ওই দৌড় আসল। তাও অত গরমে ভরদুপুরে চলা ম্যাচে!
ফাইনাল টিকিটের কালোবাজারে যা দাম উঠেছিল, টিভিতে শুনে চক্ষু চড়কগাছের জোগাড়! একটা সেন্টার কোর্ট টিকিটের জন্য ব্রিটিশরা আজ ৪৪ হাজার পাউন্ড খরচ করতেও পিছপা হয়নি। মানে প্রায় সাড়ে ৩৯ লক্ষ টাকা! গত বছর মারে বনাম ফেডেরার ফাইনাল বিবিসি টিভিতে দেখেছিল এক কোটি ৭০ লক্ষ দর্শক। আজ বিজয় অমৃতরাজ ধারাভাষ্যে বলছিল, সেই রেকর্ডও ভেঙে দিয়েছে মূলত মারে-প্রেমীরা।
ম্যাচ শুরুর আধ ঘণ্টা আগে থাকতে রয়্যাল বক্স থেকে ভিআইপি স্ট্যান্ড ভর্তি করে ফেলেছিলেন সব সুপার সেলিব্রিটিরা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন থেকে রড লেভার। ওয়েন রুনি থেকে ভিক্টোরিয়া বেকহ্যাম। স্ট্যান স্মিথ। অ্যালেক্স ফার্গুসন। ভিদিচ। কে নেই? জকোভিচের ঘনিষ্ঠ সার্বিয়ান বন্ধু, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ফুটবলার ভিদিচ তো ফাইনালের আগে বলেইছিল, “আজ আমার পুরনো বসের বিরুদ্ধে আমি।” মানে ম্যান ইউয়ের প্রাক্তন স্কটিশ ম্যানেজার ফার্গুসনের বিরুদ্ধে। কোর্টের মতো গ্যালারিও গোড়া থেকে ফুটছিল।
আসলে এ বছরটাতেই খেলার মাঠে ব্রিটিশ সিংহের গর্জন চলছে। গল্ফে ১৭ বছর পর যুক্তরাষ্ট্র ওপেন জিতেছে জাস্টিন রোজ। ইংল্যান্ডের হয়ে গত শতকে নিক ফ্যালাডোর শেষ মেজর জেতার পর। রাগবিতে শনিবারই লায়ন’স সাতানব্বইয়ের পর অস্ট্রেলিয়াকে প্রথম টেস্ট সিরিজ হারায়। ফর্মুলা ওয়ানে লুইস হ্যামিল্টন ভাল করছে। অ্যাসেজ সিরিজ তো শুরুর আগেই ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা ইংল্যান্ডকে হটফেভারিট বলে দিচ্ছে।
তার ওপর মনে করে দেখুন, আজকের তারিখটা। জুলাইয়ের সাত। সাতাত্তর বছর আগে শেষ ব্রিটিশ পুরুষ ফ্রেড পেরি উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। সব মিলিয়ে শেষ ব্রিটিশ উইম্বলডন সিঙ্গলস চ্যাম্পিয়ন ১৯৭৭-এ। মেয়েদের বিভাগে ভার্জিনিয়া ওয়েড। এমনকী আজই ছিল গত সাত বছরের মধ্যে লন্ডনের সবচেয়ে গরম দিন। সবেতে সাত। যার মানে সংখ্যাতত্ত্বেও রবিবারটা মারের দিকে ছিল। |
|
|
ট্রফি নিয়ে, গ্যালারিকে অভিবাদন। |
|
সে জন্যই কি প্রবল আত্মবিশ্বাসী ছাব্বিশ বছরের স্কটিশ তরুণ আমাদের দেশের এগারো বছরেই বিখ্যাত হয়ে ওঠা ‘স্মাইল’ পিঙ্কি-র করা টস জিতে সার্ভিস না নিয়ে ‘সাইড’ বেছেছিল? যেখানে বিশ্বের এক আর দু’নম্বর, দুই প্লেয়ারেরই সার্ভিস দুর্দান্ত, সেক্ষেত্রে মারের সুযোগ পেয়েও প্রথমে সার্ভিস না নেওয়ার সিদ্ধান্তটা অবাক করার মতো! কিন্তু ম্যাচের প্রথম গেমেই মারে ওর ও রকম সিদ্ধান্তের কারণ বুঝিয়ে দিল। প্রথম পয়েন্টেরই মীমাংসা হল ২০ শট খেলার পর। তার পর থেকে তিন ঘণ্টা ন’মিনিটের গোটা ম্যাচে দেদার পয়েন্টে কুড়ি, পঁচিশ এমনকী তিরিশটা শটও খেলা হয়েছে। আর তার বেশির ভাগ জিতেছে মারে।
এত বেশি লম্বা র্যালির জন্যই স্ট্রেট সেটে মীমাংসা হওয়া ম্যাচও তিন ঘণ্টার ওপর গড়িয়েছে। এতেই বোঝা যাচ্ছে, জকোভিচ তিন সেটে হারলেও কী অসাধারণ লড়েছে। আমার কাছে এ বারের উইম্বলডন ফাইনাল ‘পারফেক্ট চ্যাম্পিয়ন বনাম পারফেক্ট চ্যালেঞ্জারের’। টেনিস দুনিয়ার দু’জন সর্বোত্তম ফিজিক্যালি ফিট প্লেয়ারের লড়াই। কিন্তু সেখানেও যেন দ্বিতীয় সেটের মাঝামাঝি থেকে জকোভিচকে একটু হলেও ক্লান্ত মনে হল। তবে এটাও হতে পারে যে, উইম্বলডন ফাইনালের মতো সর্বোচ্চ মঞ্চে অত বার কোর্টে আছাড় খেয়ে প্রতিবার উঠে দাঁড়ালেও মানসিক ভাবে ধাক্কা খেয়েছিল। নইলে জকোভিচের মতো চিরলড়াকু পরপর দু’টো সেট ৪-১ আর ৪-২ এগিয়ে থেকে হারছে দেখাটা সত্যিই অভূতপূর্ব।
ম্যাচটা যত গড়াল ততই আমার মনে হচ্ছিল, সেমিফাইনালে দেল পোত্রোর স্ট্র্যাটেজির পাতাটা ছিঁড়ে ফাইনালে জকোভিচের বিরুদ্ধে নেমেছে মারে। জোকারকে হারাতে ওকে আক্রমণ করো। ও স্বভাবসিদ্ধ স্টাইলে বিপক্ষের ওপর ছড়ি ঘোরানোর আগে বরং ওর ওপরই প্রাধান্য বিস্তার করো। যাতে জকোভিচ ওর টেনিস-অস্ত্র ভান্ডারের যেটা পাশুপত, সেই ‘মিড কোর্ট’ থেকে ইচ্ছে মতো বিপক্ষের ফোরহ্যান্ড আর ব্যাকহ্যান্ডে দুরূহ সব কোণাকুনি রিটার্ন না মারতে পারে। |
বান্ধবীকে চুম্বন। |
তবে আমার মতে আজ জকোভিচকে দৃশ্যত দ্বিতীয় সেট থেকেই হতাশ করে তুলেছিল, মারের বেসলাইন থেকে ধারাবাহিক অবিস্মরণীয় একের পর এক রিটার্ন। জকোভিচ যা-ই মারছিল, তা-ই তুলে দিয়েছে মারে। ফেরত পাঠিয়েছে নেটের উল্টো দিকে। নিজে টেনিস প্লেয়ার বলে আরও ভাল ভাবে বুঝতে পারছিলাম, ও রকম অবস্থায় জকোভিচের মনের কী অবস্থা ছিল! প্রতিদ্বন্দ্বীর এহেন অবিশ্বাস্য রিটার্নের সামনে পড়লে তখন জয়দীপ যা, জকোভিচও তাই! মনে হবে, ‘ওরে বাবা, এটাও রিটার্ন করে দিল! তা হলে এক পর আর কী মারব?’ তৃতীয় সেটে তো মারে যে রকম অবিশ্বাস্য টেনিস খেলেছে তাতে আজ ওর উল্টো দিকে ফেডেরার বা সাম্প্রাস থাকলেও হেরে যেত। উইম্বলডন যাদের ‘সেকেন্ড হোম’।
তবু নেটের উল্টো দিকের লোকটার নাম জকোভিচ বলেই মারে দু’সেট এগিয়ে যাওয়ার পরেও অলৌকিক কিছু ঘটার আশা পুরোপুরি ছাড়তে পারছিলাম না। জানতাম, উইম্বলডনে ওপেন যুগে ফাইনালে কেউ ০-২ সেট পিছিয়ে পড়ার পর জেতেনি। শেষ ও রকম ঘটেছিল ছিয়াশি বছর আগে। ১৯২৭-এ। জকোভিচের ম্যাচে ফেরার আমার মতে একটাই রাস্তা ছিল। আরও আক্রমণাত্মক হয়ে বেশি করে নেটের সামনে ওঠা। মারেকে বেসলাইন থেকে ‘মিড কোর্টে’ টেনে এনে ওর ছন্দ নষ্টের চেষ্টা করা। তার বদলে দেখলাম, ‘জোকার’ গেমসম্যানশিপ শুরু করেছে। বারবার লাইনকল নিয়ে প্লে-অ্যাক্টিং করল। কোর্টেই ওকে ইন্টারভিউয়ে প্রশ্ন উঠল, এত উচ্চাঙ্গের ম্যাচে এত অ্যাক্টিং করলেন কেন? জকোভিচ পাল্টা রসিকতা করল, “তবু মনে হচ্ছে, সেটা যথেষ্ট ছিল না।” হাসিমুখে বলল। কিন্তু সেই হাসিতে কোনও প্রাণ নেই!
|
ফাইনালের এক জোড়া টিকিটের কালোবাজারে দর উঠল প্রায় ৭৫ লক্ষ টাকা। ম্যাচ শুরুর অনেক আগেই ভিআইপি স্ট্যান্ড, রয়্যাল বক্স ভর্তি সেলিব্রিটিরা। কে নেই সেই ভিড়ে! ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, রড লেভার, অ্যালেক্স ফার্গুসন, ওয়েন রুনি, ভিদিচ, ভিক্টোরিয়া বেকহ্যাম। ৭৭ বছর ধরে বয়ে বেড়ানো ফ্রেড পেরির ভূত নামার আশায় ফুটছিল উইম্বলডনের সেন্টার কোর্ট। ঘরের ছেলের সামনে বিশ্বের এক নম্বর নোভাক জকোভিচ। শেষ পর্যন্ত প্রার্থনা, আবেগ, বিশেষজ্ঞদের চুলচেরা বিশ্লেষণ, প্ল্যাকার্ড, কিংবদন্তি কোচের বিরল হাসি সার্থক করে ১৯৩৬-এর পর আবার উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন কোনও ব্রিটিশ। অ্যান্ডি মারে। |
|
ছবি: এএফপি, রয়টার্স |
|
|
|
|
|