আমাদের বিশ্বের প্রাচীনতম বাহন হল নৌকা। সভ্যতার শুরুর একেবারে গোড়ার দিকে, যখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা সভ্য হয়ে ওঠেনি, তখন হয়তো তাদেরই কেউ গাছের গুঁড়ি খুঁড়ে খোল বানিয়ে জলে ভাসিয়ে তার ওপর চেপে বসে। সেই থেকে মনের খেয়ালে নিজের অজান্তেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাহন নির্মাণের সূচনা করেছিল আদিম মানুষেরা। কালের বিবর্তনে গাছের গুঁড়ির সেই খোলকে আধুনিকায়ন করে আমরা নৌকার বিভিন্ন রূপ দিয়েছি। তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থলের এই পৃথিবীতে নৌকার ওপর ভর করেই গড়ে উঠেছে আজকের সভ্যতা। নৌকার বিভিন্ন রূপ পরিবর্তন হতে হতে আজকের মানুষ নতুন নতুন কল্পনা কাজে লাগিয়ে বানাচ্ছেন নতুন ধরনের সব নৌকা। চলছে নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষা। |
ফ্রান্সের এক চকলেট ব্যবসায়ী চকলেট দিয়ে এক অদ্ভুত নৌকা তৈরি করে জলে ভ্রমণ করেছেন। যদিও প্রথম বার যখন নৌকাটি বানান, তখন জলে নামাতেই সেটি আহ্লাদে আটখানা হয়ে ডুবে যায়। দ্বিতীয় বার বানানো নৌকাটি শুরুতে টালমাটাল করলেও ধকল সামলে নিয়ে দেড় ঘণ্টা জলে ভেসে বেড়াতে সক্ষম হয়। এই নৌকাটির নাম রাখা হয়েছিল চকলেটের নৌকা। এই চকলেট নৌকাটি বানিয়েছেন লারনিকল। পাশের ছবিতে লারনিকল এবং তার বন্ধু জোয়েল কে নৌকায় ভেসে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। তাঁদের এই নৌকা চালনা দেখতে প্রায় এক হাজার লোক তীরে এসে ভিড় করেছিল। |
জানা যায়, এই চকলেটে নৌকা তৈরি করতে ৪০০ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছিল। এই নৌকাটি মাত্র ৩-৫ মিটার লম্বা ছিল। লারনিকল বলেছেন, তিনি এর চেয়েও বড়, ১২ মিটার লম্বা চকলেটের নৌকা বানাবেন।
তোমরা হয়তো ভাবছ যে, এটি চকলেটের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। শুনলে অবাক হবে, এই চকলেটের নৌকাটি তৈরি করা হয়েছে পরিত্যক্ত এবং সাজানোর জন্য যে চকলেটের অপচয় হয়, সেই সব চকলেট সংগ্রহ করে। অর্থাত্ ভাল, পরিশুদ্ধ চকলেট মোটেই ব্যবহার করে অপচয় করা হয়নি। |
জন পোলক ছিলেন ওয়াশিংটনের সামান্য এক চাকুরে। জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি ঘর ছেড়ে ক্যাপিটাল হিলে চলে যান। সেখানে গিয়ে তাঁর উপলব্ধি হয়, তাঁর জীবনের স্বপ্ন কী হওয়া উচিত, সেটি তিনি বুঝতে পারেন। তিনি স্থির করেন মদের বোতলের ছিপি দিয়ে নৌকা বানাবেন। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। তিনি অতি উত্সাহিত হয়ে এক লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার তিনশো একুশটি বোতলের ছিপি জোগাড় করে ফেলেন এবং সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে তিনি সুন্দর ২৭ ফুট দীর্ঘ একখানা নৌকা তৈরি করে ফেলেন। ২০০২ সালে ওই নৌকায় চেপেই তিনি ইউলিসিসের সলিলযাত্রা শুরু করে দেন। ১৭ দিনের এক মহাকাব্যিক অভিযান করে তিনি পর্তুগালের দৌর নদীতে এসে যাত্রা শেষ করেছিলেন। |
নৌকা বাইচ যাঁরা ভালবাসেন তাঁদের কাছে এই কুমড়োর নৌকাবাইচ নিশ্চয়ই খুব উত্সাহ জোগাবে। ২০০৯ সাল থেকে জার্মানিতে ‘আন্তর্জাতিক কুমড়ো-বাইচ প্রতিযোগিতা’ শুরু হয়েছে। অবশ্য বর্তমানে আমেরিকাতেও এই নৌকা বাইচের প্রচলন দেখা যাচ্ছে। আমেরিকার বড় বড় শহরে এটি এখন আর কোনও বিরলদৃশ্য নয়। জলের মধ্যে দেখা যায় বড় বড় দৈত্য আকৃতির কুমড়ো দিয়ে বানানো নৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে। |
বি বি সি সায়েন্সের জনপ্রিয় শো ‘ব্যাং গোজ দ্য থিয়োরি’ একটি মহত্ পরিকল্পনা করেছিল। তাঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটি পরিকল্পনা পরীক্ষা করে দেখবেন। বরফ দিয়ে জাহাজ তৈরির পরীক্ষা। ধুমধাম প্রচারের মাধ্যমে তাঁরা এটি শুরু করেন। তিন সপ্তাহ ধরে এক হাজার তিনশো গ্যালন জল আর প্রচুর ভাং জমিয়ে ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি নৌকাও তৈরি করেন। কিন্তু নৌকা ছাড়ার মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেই হঠাত্ উল্টে যায়। পরীক্ষার পর শো-এর পরিচালক বলেছিলেন, ‘থিয়োরি কাজ করেছে ঠিকই, কিন্তু নির্ভরযোগ্য নয়।’ আরও বলেন, ‘অন্তত সূর্যালোকে এই নৌকার ওপর ভরসা করা চলে না।’ |
আইসক্রিম বা মালাই কাঠির নৌকা |
আইসক্রিম বা মালাই-এর পরিত্যক্ত বা বাতিল দেড় কোটি কাঠি একসঙ্গে করে ৫০ ফুট লম্বা একটি জাহাজ বানানো হয়েছিল। ২০০৮ সালে ওই নৌকাটি নেদারল্যান্ড থেকে লন্ডন পর্যন্ত পাড়ি দেয়। পাঁচ হাজার শিশুর খাওয়া আইসক্রিম থেকে জোগাড় হওয়া কাঠি ওই নৌকা তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। |
লেক কেলুনে প্রতি বছর একটি বড় জমজমাট মেলা বসে। সেখানে একটানা ১০ দিন ধরে একটি মেলার প্রধান আকর্ষণ থাকে ঐতিহ্যবাহী কার্টনের নৌকা বাইচ। স্থানীয় লোকেরা নিজেরাই সুন্দর সুন্দর নকশা করে দুধের কার্টন দিয়ে নৌকা তৈরি করে বাইচ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। এই প্রতিযোগিতার নিয়ম এবং শর্ত হল কাঠের সরু কাঠামো থাকবে কিন্তু কার্টন দিয়েই নৌকা বানাতে হবে। |
আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ থেকে করেতিন দে চাতেলপেরন নামে ২৬ বছরের এক ফরাসি যুবক গত বছর পাটের তৈরি নৌকায় চড়ে প্যারিসে পৌঁছন। তাঁরা বাংলার গৌরব ‘সোনালি আঁশ’ কাজে লাগিয়ে ওই নৌকা বানান। ওই নৌকাটি জলে ডোবার ভয় থেকে মুক্ত ছিল এবং প্রকৃতিবান্ধব তো ছিল বটেই। |
বাতিল হয়ে যাওয়া সাড়ে বারো হাজার প্লাস্টিকের বোতল জড়ো করে বানানো হয়েছিল এক বিরাট জাহাজ। এই বোতল দিয়ে তৈরি জলযানটি একটানা ১৩০ দিন ধরে জলের ওপর ভেসেছে। এই বোট বানানোর উদ্দেশ্যটি সত্যিই খুব মহত্। প্লাস্টিকের বাতিল আবর্জনা জমিয়ে টেক্সাস শহরের সমান সাইজের বিরাট এক ভাসমান আঁস্তাকুড়ের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই এই অভিযান শুরু হয়েছিল। এই দুঃসাহসিক অভিযান শেষ হয়েছে আট হাজার নটিক্যাল মাইল পথ অতিক্রম করার পর সিডনি শহরে গিয়ে। |