ফাইনালের ৬-১, ৬-৪ স্কোরলাইন দেখার পর কথাটা বলছি বলে ভুল ভাববেন না। উইম্বলডনে মেয়েদের ফাইনালে প্রায় গোটা টেনিস দুনিয়া স্টেফি গ্রাফের দেশের মেয়ে সাবিন লিজিকিকে ফেভারিট বলে রাখলেও আমার বাজি ছিল পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি, বুম বুম সার্ভার জার্মান মেয়ের ভারীভুরি চেহারার ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বী মারিয়ন বার্তোলি। লন্ডন থেকে সদ্য শহরে ফিরে শনিবার টিভিতে ম্যাচটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, উইম্বলডনে দু’জনকে চাক্ষুষ দেখার উপলব্ধিটা তা হলে আমার বৃথা যায়নি।
লিজিকির ওপর মারাত্মক প্রত্যাশার চাপ ছিল। ফাইনালে ওঠার পথে সেরেনা উইলিয়ামস-সহ আরও দুই গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন। গত বারের ফাইনালিস্ট। উইম্বলডনের আগেই ঘাসের কোর্টের ডব্লিউটিএ টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়নকে একের পর এক হারানোয় এ বার উইম্বলডনে লিজিকি হঠাৎ করে ‘সিন্ডারেলা অব টুর্নামেন্ট’ হয়ে উঠেছিল। সেখানে বার্তোলির ওপর প্রায় চাপ ছিল না। ওর দিকের ড্রয়ে সব বাঘা-বাঘা নাম আগেই হেরে বসায় গোটা টুর্নামেন্টে বার্তোলি সেরা বাছাইকে খেলেছে ১৭ নম্বর স্লোয়েন স্টিফেন্স। খোলা মেজাজে খেলতে খেলতে ফাইনালে উঠে সেখানেও খোলা মনে খেলল এ দিন। আর প্রতিপক্ষের নিখুঁত পারফরম্যান্সের পাশাপাশি নিজের টইটম্বুর আবেগের কাছেও আত্মসর্মপণ করল লিজিকি।
লিজিকি হয়তো ভেবে নিয়েছিল, ফাইনালে ও-ই জিতবে। স্রেফ কিছু সময়ের অপেক্ষা। নইলে উইম্বলডন ফাইনাল খেলতে লকাররুম থেকে বেরিয়ে সেন্টার কোর্টে কোনও প্লেয়ারকে হেডফোন লাগিয়ে ঢুকতে আমার এই টুর্নামেন্টের সঙ্গে চুয়ান্ন বছরের সম্পর্কে কস্মিনকালে দেখিনি। যেমনটা এ দিন লিজিকিকে ম্যাচের আগে করতে দেখলাম! অথচ ম্যাচে নিজের প্রথম ছ’টা সার্ভিস গেমের মধ্যে পাঁচটাই হারাল। ২৫টা আনফোর্সড এরর। টেনিসের বড় ম্যাচে অনেক ফেভারিটকে ‘চোক’ করতে দেখেছি। কিন্তু সে জন্য কোর্টে খেলা চলার সময় কাউকে কাঁদতে দেখিনি আগে! দ্বিতীয় সেটের একটা সময় লিজিকি কাঁদতে কাঁদতে খেলল! |
চ্যাম্পিয়ন হয়েই উঠে গেলেন গ্যালারিতে। কোচ মরেসমোর আলিঙ্গনে বার্তোলি। ছবি: রয়টার্স |
বার্তোলি ওর প্রাক্তন দেশোয়ালি উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন এমিলি মরেসমোর কাছে ট্রেনিং করে আর নিজের সাপোর্ট স্টাফে পরিবর্তন ঘটিয়ে নিজের খেলাকে আগের চেয়ে জমাট করেছে। সার্ভিস কোনও কালেই ভাল ছিল না। এখনও দুর্দান্ত কিছু নয়। কিন্তু আগের চেয়ে অনেক ধারাবাহিকতা এসেছে। বিশেষ করে প্রথম সার্ভে পয়েন্ট জেতার পার্সেন্টেজের ক্ষেত্রে। আর রিটার্নটা বার্তোলির বরাবরই ভীষণ ভাল। কোর্টের দু’প্রান্ত থেকেই ডাবল-হ্যান্ডেড শট মারতে পারাটা ওকে মেয়েদের ট্যুরে বিরল প্রজাতির টেনিস প্লেয়ার করে তুলেছে। এ ভাবে মারা রিটার্নগুলো নব্বই ভাগ নিখুঁত হয়। আনফোর্সড এররের ঝুঁকি খুব কম।
যে বার ও নেতাজি ইন্ডোরে সানফিস্ট ওপেন খেলতে এসেছিল, তার দু’বছর পরেই প্রথম বার উইম্বলডন ফাইনালে উঠেছিল। কিন্তু ওকে অতীতে গ্র্যান্ড স্ল্যামে আমাদের সানিয়া মির্জাও হারিয়েছে। আমার স্মরণশক্তি ধোঁকা না দিলে, সানিয়া যে বছর যুক্তরাষ্ট্র ওপেন প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল উঠেছিল, সে বার তৃতীয় রাউন্ডে বার্তোলিকে হারিয়েছিল।
সেই মেয়ে ফাইনালে দ্বিতীয় রাউন্ডের মাঝের একটু সময় বাদে কার্যত একতরফা খেলে ইতিহাসের সবচেয়ে মর্যাদামণ্ডিত গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন। দিনকয়েক আগে উইম্বলডনেই টনি রোচের মতো বহুদিনের বন্ধুদের কাছে শুনছিলাম, বার্তোলির ব্যক্তিগত জীবন গত কয়েক বছর খুব জটিল গিয়েছে। ওর বাবা ওয়াল্টার এ দিন প্লেয়ার্স বক্সে বসে মেয়ের সাফল্যে প্রচুর হাততালি দিলেও তাঁকে নিজের কোচের পদ থেকে ছেঁটে ফেলেছে বার্তোলি সম্পূর্ণ পারিবারিক কারণে। উইম্বলডনেই দু’বছর আগে নিজের ম্যাচের সময় বার্তোলি কোর্ট থেকে চিৎকার করে ওর বাবা-মাকে স্টেডিয়াম ছেড়ে চলে যেতে বলেছিল। সেই প্লেয়ার যাবতীয় ব্যক্তিগত এবং টেনিসগত সমস্যা সামলে উইম্বলডনে নতুন রানি! তাও গোটা টুর্নামেন্টে একটাও সেট না হেরে। ভাবা যায়! |