|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
নতুন প্রেক্ষিতে প্রাচীন ভারত চর্চা |
সুব্রতকুমার আচার্য |
দ্য চেঞ্জিং গেজ/ রিজিয়নস অ্যান্ড দ্য কনস্ট্রাকশনস অব আর্লি ইন্ডিয়া, ভৈরবী প্রসাদ সাহু।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৮৫০.০০ |
প্রাচীন ভারতে ইতিহাসের ক্রমবিকাশকে তথাকথিত ‘মার্কসবাদী-জাতীয়তাবাদী’ মতাদর্শে ব্যাখ্যা করাই স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে মূল ধারার ইতিহাস-রচনার দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মার্কসবাদীরা প্রাচীন ভারতের সমাজ-রাষ্ট্রকে কেন্দ্রিক বা উপকেন্দ্রিক প্রেক্ষিতে দেখতে চেয়েছিলেন, যে প্রেক্ষিত মূলত গাঙ্গেয় উপত্যকা ও তার প্রান্তবর্তী অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। পরে এ থেকেই সূচিত হয় এক গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাধারা, যা রাষ্ট্রগঠনের সামন্ততান্ত্রিক মডেল হিসেবে সুপরিচিত। কিন্তু এই মডেলের কেন্দ্রিক বা উপকেন্দ্রিক প্রেক্ষিতটি সুসংবদ্ধ সমাজ-গঠন, সমাজ-অর্থনীতির জঙ্গমতা ও বিভিন্ন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বহুত্বের মতো বিষয়গুলিকে ঠিকঠাক ধরতে সমর্থ হয়নি। এই সীমাবদ্ধতার জন্য গত তিন-চার দশক ধরে বিশেষজ্ঞরা অঞ্চলবিশেষের ঐতিহাসিক ঘটনা-পরম্পরা বুঝতে আঞ্চলিক বিশিষ্টতাকেই প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আদি-মধ্যযুগীয় রাজস্থান, তামিলনাড়ু ও ওড়িশার প্রেক্ষিতে এই সূত্র ইতিমধ্যেই কাজে লেগেছে।
ভৈরবী প্রসাদ সাহু-র গ্রন্থ দ্য চেঞ্জিং গেজ বিভিন্ন অঞ্চল, তাদের আন্তঃসম্পর্ক ও রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে নতুন প্রেক্ষিতে বুঝতে চেয়েছে। সংঘাত ও পরিবর্তনশীলতা অঞ্চল মাত্রেরই বৈশিষ্ট্য। সেখানে যেমন কেন্দ্র ও প্রান্তের অসম সম্পর্কসূত্রের টানাপড়েন, তেমনই আবার ঘরকুনো কৃষক, রাখালিয়া ও পাহাড়িদেরও জীবন বিধৃত। আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক ও আন্তঃঅঞ্চল সম্পর্কের যে দ্বন্দ্ব, সেই বিস্তৃত পরিসরটিও এখানে আলোচিত (পৃ. ১৯)। এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত বারোটি প্রবন্ধ তিনি গত দু’দশকে লিখেছেন। প্রবন্ধগুলি তিনটি ভাগে বিন্যস্ত, প্রতিটি ভাগে চারটি করে প্রবন্ধ। এর প্রায় অর্ধেক ওড়িশা ও ছত্তীসগঢ় নিয়ে এবং বাকিগুলি বিভিন্ন অঞ্চলের তথ্যভিত্তিক হওয়ায় অনেকখানি প্রসারিত। ভূমিকায় (পৃ. ১-২৮) পরিব্যাপ্ত একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের পরিসরে বিশেষ একটি অঞ্চলকে বুঝবার বিবিধ সমস্যা ও তার পরিপ্রেক্ষিত আলোচিত। তাঁর বিশ্বাস, “নানা অঞ্চল জুড়ে এই যে মিশ্র, বহুমুখী সমাজের স্থিতি, এরা যান্ত্রিক ভাবে সংবদ্ধ হয়নি, বরং অনুকরণ, প্রতিযোগিতা ও বৈরমূলক সহনশীলতার মতো নানান প্রক্রিয়ায় এত দিন ধরে টিকে আছে।” (পৃ. ৫)
প্রথম অংশে প্রতাপী ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যের সার্বিক কাঠামোর মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রাথমিক চেহারাটি বর্ণিত হয়েছে। জাতি-বর্ণের কেতাবি ধারণা এবং জাতি-বর্ণভিত্তিক সমাজের উৎসের প্রকৃত ভিত্তির মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই জাতি-বর্ণভিত্তিক সমাজের অসমসত্ত্ব ভিত্তিটি গড়ে উঠেছিল। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই ওড়িশাতেও লেখক ‘ব্রাহ্মণ’ ও ‘অব্রাহ্মণ’দের নিয়ে গঠিত এক দ্বিস্তর ‘বর্ণ’ কাঠামো চিহ্নিত করে জোর গলায় বলেছেন, ঐতিহাসিক কারণেই এই অঞ্চলে ‘ক্ষত্রিয়’ ও ‘বৈশ্য’ বর্ণ গড়ে উঠতে পারেনি। মহাকাব্য, পুরাণ ও আদি-মধ্যযুগীয় লিপিমালায় বর্ণিত কলিযুগকে একটি সংকটকাল বা প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার উপরে আক্রমণ হিসেবেই ধরা হয়। লেখক অবশ্য জোর দিয়ে বলেছেন এ হল প্রত্যয়ের সংকট, এবং এর নির্মাণ, তাঁর মতে, ব্রাহ্মণ্য মতাদর্শের উত্থানেই নিহিত। “কলিযুগের ধারণা বা রূপকটি, আরও বহু প্রতীকের মতোই, সমসময়েরই নির্মাণ, এবং এই ধারণার মধ্যে ওই অঞ্চলে সমসাময়িক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়াগুলিও চমৎকার ভাবে বিধৃত।” (পৃ. ৫৬)। চতুর্থ অধ্যায়ে (পৃ. ৮০-১০৫) রয়েছে দক্ষিণ কোশল (পশ্চিম ওড়িশা ও ছত্তীসগঢ়) কী ভাবে একটি উপ-অঞ্চল হয়ে উঠছে, তার কথা। গোড়ার দিকের খণ্ডিত আঞ্চলিক অস্তিত্ব থেকে পরবর্তী কালে সর্বজনীন সংস্কৃতি দিয়ে গ্রথিত এক বৃহৎ অঞ্চলোত্তর সমষ্টি হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য এই অঞ্চলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক রূপান্তরের গতিপথটি বুঝবার চেষ্টা করা হয়েছে। এই অঞ্চলের উৎখনিত প্রত্নস্থলগুলি দেখে এবং এখানকার শিলালিপি ও মুদ্রা ইত্যাদির ভিত্তিতে বিচার করে তিনি অত্যন্ত প্রত্যয়ী ভাবে তাঁর যুক্তি সাজিয়েছেন। এই অঞ্চলের শাসনব্যবস্থার বিবর্তন, গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ, গ্রামীণ জনবসতি, বর্ণভিত্তিক সমাজে উত্তরণ, রাজানুগ্রহে লোকপ্রিয় ও আদিম দেবদেবী-বন্দনা এবং শিল্পরীতি ও স্থাপত্যের বিশিষ্টতা বিচার করে তিনি এই অঞ্চলের সত্তাটিকে চিহ্নিত করেছেন।
দ্বিতীয় অংশে আঞ্চলিক শাসনব্যবস্থার গতিপ্রকৃতির রূপরেখাটি অঙ্কিত হয়েছে। ভারতের প্রথম দিককার রাষ্ট্র-ইতিহাস রচনার পরিপ্রেক্ষিতটি গত কয়েক দশকে কী ভাবে পালটেছে, পঞ্চম অধ্যায়ে (পৃ. ১০৯-১২৮) সেটি আলোচিত। উত্তর ভারতে রাষ্ট্রধারণার উদ্ভব ও মৌর্য ‘রাষ্ট্র’কে রোমিলা থাপার যেমন ভাবে দেখেছেন, বা অন্যান্য নানা অঞ্চলে রাষ্ট্রধারণার উদ্ভবকে ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, হেরমান কুলকে, ওয়াই সুব্বারায়ালুু ও এস সেনাভিরত্নে’রা যে ভাবে দেখেছেন, তার মূল্যায়ন করেছেন লেখক। পরের দুটি অধ্যায়ে ওড়িশায় রাষ্ট্রের প্রারম্ভিক ধারণা ও আদি-মধ্যযুগের শুরুতে দক্ষিণ কোশল ও তারও ওপারে শাসন-কাঠামোর বিবর্তন আলোচিত হয়েছে। প্রাচীন ওড়িশায় রাষ্ট্রধারণার উদ্ভব প্রসঙ্গে স্থানীয় জনপদগুলির উত্থান ও আদি-ঐতিহাসিক যুগে তার রূপান্তরের বিষয়টি এখনও অস্পষ্ট। এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের স্তরগুলি সর্বত্র সমান ছিল না। কিছু জনপদ, বিশেষত উপকূল অঞ্চলের কিছু স্থান যেমন শুরুতেই গুরুত্ব অর্জন করেছিল, ওড়িশার ভিতরের অনেক অঞ্চলে উন্নয়নের রূপরেখা তেমনই অসংবদ্ধ ও চরম অস্পষ্ট ছিল। (পৃ. ১৪২)। মধ্যযুগের শুরুতে রাজতন্ত্র, অভিজাত মতাদর্শ, কৃষির উন্নতি ও কৃষক শ্রেণীর প্রসারের ফলে এই অস্পষ্ট, অসম উন্নয়ন মুছে যায়। এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিল সমসাময়িক প্রক্রিয়ার কারণেই। “সাবেকি বৃহৎ রাষ্ট্রকাঠামোর বিলোপের সূত্র ধরে নয়, বরং এদের উদ্ভব স্থানীয় সমাজগুলির অভ্যন্তরীণ রূপান্তর থেকে। এই রূপান্তর সম্ভব হয়েছিল অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগসূত্রের মাধ্যমে। কালক্রমে কৃষিভিত্তিক অঞ্চলগুলির ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক সংহতি এখানে বৃহৎ রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলে।” (পৃ. ১৭৪)
বৈধতার বিষয়ে লেখক ঠিকই বলেছেন যে, আদি-ঐতিহাসিক পর্বে ক্ষমতাসীন অভিজাতদের ‘যুদ্ধং দেহি’ মতাদর্শই ক্ষমতাকে বৈধতা দিয়েছিল। কিন্তু আদি-মধ্যযুগে ব্রাহ্মণ্য মতাদর্শ এই জায়গাটা দখল করে। পারস্পরিক পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থন-পুষ্ট এই ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় সম্পর্কই ক্ষমতাকে বৈধ করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল।
তৃতীয় অংশে আঞ্চলিক ভূমি ব্যবস্থা, গ্রামীণ জনবসতি ও সমাজ, কৃষি-নির্ভর অর্থনীতি, কৃষক-সমাজ ও সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় আলোচিত হয়েছে। লেখক হরপ্পা যুগ থেকে গুপ্ত ও গুপ্ত-পরবর্তী পর্বে কৃষি-নির্ভর অঞ্চলসমূহের বিবর্তনের রূপরেখা চিহ্নিত করে বলেছেন, “এই অঞ্চলে ও উপ-অঞ্চলগুলিতে কৃষিভিত্তিক কেন্দ্র গড়ে ওঠা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া ছিল, এবং এর ফলে আদ্যন্ত নতুন এক সামাজিক ও রাষ্ট্রিক কাঠামোর সূচনা হয়।” (পৃ. ২৩০)। পরবর্তী অধ্যায়গুলির প্রধান আলোচ্য ওড়িশার রাষ্ট্রগঠন, কৃষি-নির্ভর অর্থনীতি ও মধ্যযুগের সূচনায় তার পরিবর্তন। তবে ‘সামন্ততান্ত্রিক পীড়ন ও কৃষক পরাধীনতার এক উত্তম উদাহরণ ওড়িশা’ (পৃ. ২৬৯)— লেখকের এই বিশ্বাসের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের ‘সবচেয়ে নম্র জমিদারশ্রেণী’ (পৃ. ২৬৭) হিসেবে দেখানোর বৈপরীত্য বিভ্রান্তি জাগায়। আবার ওড়িশার দুটি উপ-অঞ্চল কলিঙ্গ ও খিজিঙ্গকোট-এর মধ্যে তুলনা টেনে অসম সামাজিক গঠন ও বিভিন্ন অঞ্চলব্যাপী উন্নয়নের বিন্যাস প্রসঙ্গে লেখকের অভিমত খুবই যুক্তিযুক্ত।
প্রতিষ্ঠিত নিয়মনীতির বিরুদ্ধে পরাধীন মানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি তামিলনাড়ু, কর্নাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশে একই পরিস্থিতি পর্যালোচনাকারী আরও অনেক ঐতিহাসিকের সঙ্গে সহমত। কিন্তু ওড়িশার ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, সমাজ-রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনজাতীয়-বিক্ষোভের কিছু নজির থাকলেও জগন্নাথ ‘কাল্ট’-এর মধ্যে আদিম দেবদেবীদের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া এবং উচ্চবর্ণ ও জনজাতীয়দের ধারাবাহিক সম্পর্ক বজায় রাখার ফলে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা কখনওই বিপন্ন হয়নি।
বইটি এ ভাবেই পরিচিত পরিপ্রেক্ষিত থেকে, কেন্দ্র থেকে প্রান্তের দিকে আমাদের নিয়ে যায়। সমগ্র আলোচনাতেই লেখক জনপদ, অঞ্চল ও আন্তঃআঞ্চলিক যোগসূত্রের চালিকাশক্তি হিসেবে সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়াগুলির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ‘ভারতীয় সামন্ততন্ত্র’ মডেলের বৃহত্তর পরিসরের মধ্যে থেকেও আদি-ঐতিহাসিক পর্বে রাষ্ট্রগঠন বিষয়ে নতুন ভাবনা ও প্রক্রিয়ার কথা তুলে ধরার জন্য তাঁর সাধুবাদ প্রাপ্য। |
|
|
|
|
|