তিন মাসে কত দূর পাল্টেছে ছবিটা?
ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস সংলগ্ন, সোনারপুর থানার নাজিরাবাদের একটি স্টুডিওয় টিভি গেম-শোয়ের শ্যুটিং চলাকালীন প্রশ্নটা শুনে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়। “কিচ্ছু বদলায়নি! আমাদের এসি ফ্লোরে আগুন লাগলে একটি মাত্র দরজা দিয়ে বেরোতে সেই হুড়োহুড়ি-ঠেলাঠেলিই হবে। হয়তো সকলে অসহায়ের মতো একসঙ্গে পুড়েই মরব!”
তিন মাস আগে টালিগঞ্জের দাসানি স্টুডিওয় ওই গেম শোয়ের শ্যুটিং চলাকালীনই আগুনের জেরে আতঙ্কে সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন সঞ্চালক রচনা। সেই স্টুডিও এখন বন্ধ রেখেছে প্রশাসন। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল প্রযোজিত ওই গেম শোয়ের শ্যুটিং চলছে ঠিকানা পাল্টে কখনও নিউ টাউন, কখনও বাইপাসের কাছে। ফিল্ম-টিভির শ্যুটিংয়ের ঝকঝকে সেট কেন এমন ‘মৃত্যুফাঁদ’ হয়ে থাকবে, তিন মাস আগে সে প্রশ্নও ছুড়ে দিয়েছিলেন রচনা। তিন মাস বাদেও তাঁর নিষ্ফল ক্ষোভের চেহারাটা সেই একই রকম থেকে গিয়েছে। |
এখন নাজিরাবাদের এআরকে স্টুডিও, যেখানে ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ নামে ওই গেম শোয়ের শ্যুটিং হচ্ছে, সেখানে নিরাপত্তার হাল-হকিকত কার্যত একই রকম। এসি ফ্লোরের মাপটা দাসানি স্টুডিওর তুলনায় সামান্য বড় হলেও বেরোনোর দরজা সেই একটি। দাসানিতে মেক-আপ রুম লাগোয়া একটি চিলতে করিডর ছাড়া আরও একটি বেরোনোর পথ ছিল। আলো ফেটে স্টুডিও আগুনের ফুলকি ও ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়ার সময়ে তাতেও কলাকুশলী, অনুষ্ঠানের প্রতিযোগী, দর্শকদের মধ্যে ত্রাহি-ত্রাহি রব পড়ে গিয়েছিল। এআরকে স্টুডিওর ফ্লোরে সবেধন নীলমণি দরজার বাইরে একটি সরু গলি, ভিতরে শ্যুটিংয়ের সময়ে থাকেন অন্তত জনা পঞ্চাশ লোকজন। বুধবার শ্যুটিংয়ের ব্রেকে রচনা বলছিলেন, “আমি (সঞ্চালক) ও গেম শোয়ের প্রতিযোগীরা থাকি একেবারে ভিতরে। বিপদ ঘটলে আমাদের কী হতে পারে, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।” ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা জানালেন, চেষ্টা চলছে ফ্লোরের অন্য পাশে বেরোনোর আর একটি রাস্তা তৈরির। কিন্তু স্টুডিও-ফ্লোরে জায়গার এমনই অভাব, রচনার সাজগোজের জন্যও মেক-আপ ভ্যান আনতে হয়েছে। স্টুডিওর ম্যানেজার মধুসূদন দাস অবশ্য জানিয়েছেন, বিপদের কথা ভেবে তাঁরা জলের ব্যবস্থা রেখেছেন। ছাড়পত্র পেতে দমকলের চূড়ান্ত পরিদর্শনের জন্য অপেক্ষা চলছে। |
এ কোনও বিচ্ছিন্ন নমুনা নয়। গত ৫ এপ্রিল দাসানি স্টুডিওয় অগ্নিকাণ্ডের পরেও কলকাতা বা সংলগ্ন এলাকায় বেশির ভাগ স্টুডিওর অগ্নিসুরক্ষায় খামতি থাকার কথা স্বীকার করে নিচ্ছেন প্রশাসনের কর্তা থেকে বিনোদন-জগতের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই। এর আগে ভারতলক্ষ্মী, আনন্দপুর ও মহেশতলাতেও শ্যুটিংয়ের সময়ে অঘটনের নজির রয়েছে। অথচ, দাসানির ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে স্টুডিও এবং প্রযোজকদের পথে আনতে তড়িঘড়ি বৈঠকে বসেন যুবকল্যাণমন্ত্রী (যিনি একই সঙ্গে সরকারি টেলি অ্যাকাডেমিরও চেয়ারম্যানও) অরূপ বিশ্বাস। তখনই ১৫ জুনের মধ্যে কলকাতা, রাজপুর-সোনারপুর, মহেশতলা, বারুইপুরের মতো কিছু পুর-এলাকার ৬০টি স্টুডিওকে দমকলের ছাড়পত্র ও পুর-কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্মাণগত স্থিতিশীলতার শংসাপত্র জোগাড় করতে বলা হয়। যে সব বাগানবাড়ি, পুরনো বাড়ি বা ফ্ল্যাটে শ্যুটিং হয়, তাদেরও ওই চত্বরের বিভিন্ন বাসিন্দা ও প্রশাসনের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করার নির্দেশ দেয় রাজ্য সরকার। আর প্রযোজকদের বলা হয়, শ্যুটিংয়ের সময়ে নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনও আপস না করে পুলিশ-প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে কাজ করতে।
সরকারি সময়সীমার মেয়াদ শেষের তিন সপ্তাহ বাদে অরূপবাবু বলছেন, “পঞ্চায়েত ভোটের দিন ঘোষণার পরে এ ব্যাপারে এখনই কড়া পদক্ষেপ করা যাচ্ছে না। ভোটটা মিটলেই আমি সব স্টুডিও-মালিক, প্রয়োজক এবং কলাকুশলীদের নিয়ে বসব।” তা হলে এত দিন কী করল রাজ্য সরকার? সব স্টুডিও ও প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত নোডাল অফিসার দেবপ্রিয় বিশ্বাস (দমকলের প্রাক্তন এডিজি) বলেন, “এ ব্যাপারে আমায় খুব বেশি কাজে লাগানো হয়নি।” বৃহস্পতিবার দুপুরেই স্টুডিও-মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দমকলের ডিজি দুর্গাপ্রসাদ তারানিয়া। তিনি বলেন, “নিরাপত্তার জন্য খুব বেশি খরচের কোনও ব্যবস্থা নিতে এখনই কড়াকড়ি করা হচ্ছে না। যেগুলি না মানলেই নয়, সেগুলিই আপাতত করতে বলা হচ্ছে।” ডিজি যেমন জলের সংস্থান রাখা, পোর্টেবল পাম্প, হোসপাইপ মজুত রাখা, ফ্লোরের দরজাগুলি চিহ্নিত করে রাখায় জোর দিচ্ছেন। তবে এখনও পর্যন্ত এই বিষয়গুলি খেয়াল নেই বেশির ভাগ স্টুডিও-মালিকের। তথ্য-সংস্কৃতি সচিব অত্রি ভট্টাচার্য বলেন, “স্টুডিওগুলিকে আমরা আরও কিছুটা সময় দিচ্ছি।” |
দাসানির ঘটনার পরে সরকার শুধু স্টুডিও-কর্তৃপক্ষ নয়, কোনও অঘটন ঘটলে প্রযোজকদেরও তার দায় নিতে হবে বলে জানিয়ে দিয়েছিল। তাতে যে খুব একটা হুঁশ ফেরেনি, তা ‘দিদি নম্বর ওয়ান’-এর নতুন ফ্লোরের চেহারাতেই পরিষ্কার। প্রযোজক জি-বাংলার প্রোগ্রাম হেড (নন-ফিকশন) নবনীতা চক্রবর্তীকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব এড়িয়ে যান।
কলাকুশলীদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে বিপজ্জনক পরিবেশে শ্যুটিং করার প্রবণতায় বিরক্ত ইন্ডাস্ট্রির একাংশ। পরিচালক অনীক দত্তের মতো কেউ কেউ মনে করেন, কলকাতার কাছেও এখন বেশ কিছু আধুনিক স্টুডিও গড়ে উঠেছে, যারা নিরাপত্তা বা কাজের মানে আপস করে না। কিন্তু ফিল্ম-সিরিয়াল পরিচালকদের কারও কারও মত, কিছু প্রয়োজকের কম খরচে কাজ হাসিল করার মানসিকতার জন্যই বিপজ্জনক স্টুডিওগুলির এত রমরমা।
|