আলু-সহ বিভিন্ন সব্জিতে কৃত্রিম রঙ মাখানো বন্ধ করতে নির্দেশ জারি করেছে রাজ্য সরকার।
রাজ্য প্রশাসন সূত্রের দাবি, বিভিন্ন জেলায় সংশ্লিষ্ট সমস্ত সরকারি দফতরে ওই নির্দেশিকা ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছে। তবে সে ভাবে নজরদারি শুরু হয়নি। ফলে কৃত্রিম রঙযুক্ত শাক-সব্জিই দেদার বিকোচ্ছে মহানগর থেকে মফঃস্বল বা গ্রাম সর্বত্র। হুগলি, বর্ধমান, দুই মেদিনীপুর-সহ রাজ্যের কিছু জেলায় হাতেগোনা দু’একটি জায়গায় আলুর আড়তে হানা দিয়েছে পুলিশ। বাম আমলেও অবশ্য এ ব্যাপারে নির্দেশ জারি হয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি।
রাজ্যের কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, “সব্জি-সহ নানা খাদ্যে বহু সময়ই ববসায়ীরা রঙ মেশান। তাতে মানুষের শবীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। তা ঠেকাতেই রাজ্যের ফুড কমিশন এই বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। নজরদারি চালানো হচ্ছে। তবে সরকারি কর্মী-অফিসারেরা ভোটে ব্যাস্ত থাকায় কাজ কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে।” কৃষি প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্না বলেন, “বাম আমলেও সরকারি নির্দেশ ছিল। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এ বার তা হবে। পঞ্চায়েত ভোট মিটে গেলে সরকার এ ব্যাপারে উঠেপড়ে লাগবে।”
কৃষি বিপণন দফতর সূত্রের খবর, আলুকে দেখনদারি করতে ইটের গুঁড়ো অথবা অ্যালামাটি মাখানো হয়। চাষির ফলানো ঢ্যাঁড়শ, পটল, উচ্ছের রঙও দিব্যি বদলে যায় তুঁতে গোলা জলে ডুবে। নানা রকম রঙ মেশানো হয় বলেও অভিযোগ। ফলস্বরূপ, খাবারের মাধ্যমে শরীরে নিশ্চিতভাবেই বাসা বাধে রোগ-জীবানু। কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, কোনও ফসলের উপরে রঙ মাখানো হলে তা অবধারিতভাবেই সব্জির ভিতরে প্রবেশ করে। |
আইএমএ-র সদস্য চিকিৎসক প্রদীপ দাস বলেন, “তুঁতে (কপার সালফেট) নির্দিষ্ট মাত্রার থেকে বেশি শরীরে গেলে আস্তে আস্তে তা জমতে থাকে। এই বিষক্রিয়াকে বলে কিউমিলেটিভ টক্সিসিটি। পরবর্তীকালে এ থেকে লিভার বা কিডনির সমস্যা, খাদ্যে অরুচি, জণ্ডিস প্রভৃতি রোগ হতে পারে। অ্যানিমিয়াও হতে পারে। আর কৃত্রিম রঙের প্রভাবে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। ইটের গুড়োয় থাকা রেড অক্সাইডও ক্ষতিকর।” ত্বক ও অ্যালার্জি বিশেষজ্ঞ উমা অগ্রবাল বলেন, “সব্জির রঙ থেকে নানা ধরণের অ্যালার্জি হতে পারে। হজমের সমস্যা হয়। এমনকী দীর্ঘদিন ধরে সব্জি কাটার ফলেও হাতে সংক্রমণ হতে পারে।”
দক্ষিণবঙ্গে পুলিশ কিছু নজরদারি চালালেও উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে এখনও সেইভাবে কাজ শুরু হয়নি। হুগলির সিঙ্গুর, হরিপাল, তারকেশ্বর, পুড়শুড়া, বলাগড়-সহ নানা জায়গায় প্রচুর পরিমানে আলু এবং অন্যান্য ফসল হয়। হিমঘর থেকে বের করার পরে আলুর রঙ অনেকটা ফিকে হয়ে আসে। সেই রঙ ফেরাতে বাছানদারদের মাধ্যমে ইটের গুড়ো, অ্যালামাটি মাখিয়ে আলুর চেহারা ঝা-চকচকে করা দীর্ঘদিনের রীতি। আলুর কোনও অংশ পচে গেলে ইটগুঁড়ো বা লাল রঙে তা-ও দিব্যি ঢেকে যায়। নালিকুল, হরিপাল, তারকেশ্বর, পুড়শুড়া, ধনেখালিতে বহু হিমঘর আছে। সব জায়গাতেই এখনও কৃত্রিম ভাবে রাঙানো হচ্ছে আলু। একই অবস্থা বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর বা উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো জেলাগুলিতেও। এই সমস্ত জেলার হাটে-বাজারে রঙের বালতিতে ঢেঁড়স, পটল, উচ্ছে, বিন্স, কাকরোল ডোবানো হচ্ছে। টাটকা ভেবে তা কিনছেন গৃহস্থেরা। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, দীর্ঘদিন ধরেই ফসলের রূপ ফেরাতে কৃত্রিম রঙ মেশানো হয়। রাজ্য কৃষি দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “সব্জিতে রঙ নিষিদ্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সিদ্ধান্তের প্রয়োগ কী ভাবে হবে? সেটাও নির্দিষ্ট করা আগে দরকার।”
কি বলছেন ব্যবসায়ীরা? প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির তরফে এই নির্দেশকে স্বাগত জানানো হয়েছে। সিঙ্গুর আলু ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সুকুমার সামন্ত বলেন, “প্রশাসনের নির্দেশ পেয়ে আলুতে অ্যালামাটি বা ইটগুড়ো মাখানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হল রঙ ছাড়া আলু অসম, অন্ধপ্রদেশ, বিহার, ওড়িষা কোথাও চালানো যাচ্ছে না। তাই কেউ কেউ আবার ইটগুড়ো বা অ্যালামাটি মাখাচ্ছেন।” সুকুমারবাবুর মতে, “হিমঘরে আলু রাখার পদ্ধতি একটু বদল করলেই রঙ মাখানোর প্রয়োজন হবে না। মাঝপথে নির্দেশিকা আসায় সমস্যা হচ্ছে। পরের বার থেকে এই অসুবিধা হবে না। আলুর পাশাপাশি সব্জি আর ফলে রাসায়নিক রঙ ব্যবহার বন্ধ করাও জরুরি।” |