দোতলার ঘেরা বারান্দাটাই হয়ে গিয়েছিল রান্নাঘর। সেখানে বসেই সকালে চা তৈরি করছিলেন বছর পঞ্চাশের প্রৌঢ়া, পোস্তার বাসিন্দা বিমলা কেডিয়া। হঠাৎই হুড়মুড় করে বারান্দা ভেঙে পড়ায় চাঙড়-সহ তিনি পড়লেন একেবারে নীচে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক ব্যক্তির উপরে।
বুধবার সকাল ন’টা নাগাদ ঘটনাটি ঘটেছে জোড়াবাগান থানা এলাকার পোস্তায়, মহর্ষি দেবেন্দ্র রোডে। গুরুতর জখম হয়েছেন বিমলাদেবী। বারান্দার চাঙড় সুদ্ধ তিনি যাঁর উপরে পড়েছিলেন, সেই ব্যক্তির ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। পুলিশ জানিয়েছে, মৃতের নাম রামনন্দন মাহাতো (৫৫)। তিনি পোস্তার ওই এলাকাতেই মোটবাহকের কাজ করতেন। সকালে কাজে যাচ্ছিলেন ওই রাস্তা দিয়ে।
ওই বাড়ির উল্টো দিকেই থাকেন বলরাম পাসোয়ান। বলরামবাবু বলেন, “হঠাৎ প্রচণ্ড একটা শব্দ হল। দেখি, উল্টো দিকের বাড়ির বারান্দাটা চাঙড় সুদ্ধ ভেঙে পড়েছে। চাঙড়ের উপরে ওই মহিলা পড়ে রয়েছেন। নীচে চাপা পড়ে আছেন আর এক জন। আমরাই দু’জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠাই। চাঙড়ের নীচে চাপা পড়া ব্যক্তিকে দেখে মনে হচ্ছিল, ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছেন।” |
ভাঙা বারান্দা থেকে খসে পড়ছে চাঙড়। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র |
মহর্ষি দেবেন্দ্র রোডের যে বাড়িটিতে ঘটনাটি ঘটে, সেই বাড়িটি আনুমানিক ৫০ থেকে ৬০ বছরের পুরনো। তবে চারতলা ওই বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণ খুব খারাপ নয়। বাড়িটি বিপজ্জনক বলে কোনও নোটিসও ঝোলেনি। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বাড়িটির ঝুলন্ত বারান্দাটাই ছিল বিপজ্জনক। তাঁদের মতে, শুধু ওই বাড়িটিরই নয়, ওই রাস্তার ধারে দোতলার প্রায় সমস্ত ঝুলন্ত বারান্দাই বিপজ্জনক।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, পোস্তার ওই এলাকাটিকে বলা হয় লঙ্কাপট্টি। ওই রাস্তা দিয়ে রাতে লঙ্কা বোঝাই বড় বড় ট্রাক ঢোকে। সেগুলি যাওয়ার সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই দোতলার ঝুলন্ত বারান্দাগুলিতে ঘষা খায়। এ ভাবে বারবার ঘষা খাওয়ায় ওই বারান্দা ধরে রাখার যে বিম, তা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে।
এ দিন যে বাড়ির বারান্দা ভেঙে দুর্ঘটনাটি ঘটে, সেই বাড়ির বাসিন্দা ও বিমলাদেবীর বড় ছেলে মনোজ কেডিয়া বলেন, “মাঝেমধ্যেই আমাদের বারান্দায় ট্রাকের ঘষা খাওয়ার ঘটনা ঘটে। মঙ্গলবার রাতেও আমরা বারান্দায় ট্রাকের ঘষা খাওয়ার আওয়াজ পেয়েছি। কিন্তু এমন ঘটনা যে আজই ঘটবে, বুঝতে পারিনি।” মনোজ জানান, ট্রাকের ঘষা খাওয়ার বিষয়টি তাঁরা পুরসভাকে আগেও জানিয়েছেন। কয়েক বছর আগে পুরকর্মীরা এসে বারান্দা মজবুত করে দিয়ে গিয়েছিলেন। ফের মনোজরা পুরসভায় বিষয়টি জানান। আগামী রবিবার পুরকর্মীদের বারান্দা মেরামত করার কথা ছিল। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আসেন এলাকার বিধায়ক শশী পাঁজা। ঘটনাস্থলে আসা পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারেরা স্বীকার করে নিয়েছেন, ওই রাস্তায় বাড়ির বারান্দাগুলি ট্রাকের ঘষা খেয়ে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি, এলাকার বাসিন্দাদের সচেতনতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। ৪ এবং ৫ নম্বর বরোর এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার অশ্রুকান্তি ঘোষ বলেন, “এক-একটা ঝুলন্ত বারান্দাকে ঘিরে কেউ রান্নাঘর, কেউ বা ভাঁড়ার ঘর বানিয়ে ফেলেছেন। ঝুলন্ত বারান্দায় গ্যাস সিলিন্ডারের মতো ভারী জিনিস রাখা একেবারেই ঠিক নয়। পুরসভা থেকে বারান্দাকে কোনও ভাবেই রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়নি।”পুর-ইঞ্জিনিয়ারেরা জানান, ট্রাকের ঘষা খাওয়া আটকাতে তাঁরা ওই এলাকার কয়েকটি ঝুলন্ত বারান্দা কিছুটা উঁচু করে দিয়েছেন। অশ্রুকান্তিবাবু বলেন, “আমরা বহু বার এই এলাকায় বাড়িগুলিকে নোটিস দিয়ে বলেছি বারান্দা ঠিক করার জন্য। মাঝেমধ্যে আমরা পর্যবেক্ষণও করি। তবে এলাকার মানুষদেরও সচেতন হতে হবে।” এ ব্যাপারে কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ওই বাড়িটির অবস্থা খারাপ জানিয়ে নোটিস দেওয়া হয়েছিল এবং বারান্দা মেরামত করতেও বলা হয়েছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। দুর্ভাগ্যবশত, আইনি নোটিস দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই।” |