প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার লগ্নি। আর তার হাত ধরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে অন্তত ৩০ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ। শেষ মুহূর্তে একেবারে অভাবনীয় কিছু না-ঘটলে আর দিন দশেকের মধ্যে এই দুই সম্ভাবনাই রাজ্য ছাড়তে চলেছে বলে আশঙ্কা করছে শিল্পমহল।
উত্তরপাড়ায় হিন্দমোটর কারখানার বাড়তি জমিতে তথ্যপ্রযুক্তি সেজ (বিশেষ আর্থিক অঞ্চল) তৈরি করার কথা বেসরকারি সংস্থা বেঙ্গল শ্রীরামের। ৬০ একরের উপর প্রস্তাবিত এই প্রকল্পের জন্য কেন্দ্রের কাছে ছাড়পত্রও মিলেছে প্রায় তিন বছর আগে। কিন্তু গাঁথা হয়নি একটি ইটও। আগামী ১৩ জুলাই পর্যন্ত এই সেজ প্রকল্পের বৈধতা রয়েছে। কিন্তু প্রকল্পে কোনও কাজ না হওয়ায় ছাড়পত্রের সময়সীমা বাড়াতে রাজি হয়নি কেন্দ্র। মার্চেই অনুমোদন পর্ষদ জানিয়ে দিয়েছে যে, নতুন করে সময়সীমা বাড়ানো হবে না। অর্থাৎ, আর দিন দশেকের মধ্যে প্রকল্পে হাত না দিলে সেজ-এর সুবিধাই বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু রাজ্য, হিন্দমোটর ও বেঙ্গল শ্রীরামের মধ্যে ত্রিমুখী সমস্যায় এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে জুলাইয়ের মধ্যে কাজ শুরুর সম্ভাবনা যথেষ্ট কম বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। একেবারে শেষ মুহূর্তে অবিশ্বাস্য কিছু না-ঘটলে, এই তথ্যপ্রযুক্তি সেজ প্রকল্পের রাজ্য ছেড়ে যাওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা বলে মনে করছে তারা।
সেজ নিয়ে শাসক দলের অবস্থানের কারণে ইনফোসিসের বিনিয়োগ তো আটকে আছেই। আগে বিশ্ব বাজারে মন্দার কারণে অনুমোদন পেয়েও তথ্যপ্রযুক্তি-সেজ তৈরি থেকে পিছিয়ে এসেছে ভিডিওকন এবং বাটা। এ বার বেঙ্গল শ্রীরামের প্রস্তাবিত প্রকল্পও পাততাড়ি গোটালে রাজ্যের শিল্পায়নের পক্ষে তা ফের বড়সড় ধাক্কা হবে বলে আশঙ্কা করছে শিল্পমহল।
২০০৬ সালে সি কে বিড়লা গোষ্ঠীর সংস্থা হিন্দমোটরকে চাঙ্গা করতে তাদের ৩১৪ একর জমি বিক্রির অনুমতি দেয় পূর্বতন বাম সরকার। শর্ত ছিল, সংস্থা চাঙ্গা করতে প্রয়োজনীয় ৮৫ কোটি টাকা ওই জমি বিক্রি করে তুলতে পারবে হিন্দমোটর। প্রায় সাড়ে দশ কোটি টাকার বিনিময়ে সংস্থাকে ওই জমি বিক্রির জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন দিয়েছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু বেঙ্গালুরুর সংস্থা শ্রীরাম প্রপার্টিজকে জমি বেচে মোট ২৮৫ কোটি টাকা পায় হিন্দমোটর। আমেরিকার দুই সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে শ্রীরাম প্রপার্টিজ তৈরি করে বেঙ্গল শ্রীরাম।
কিন্তু গোল বাঁধে ওই বাড়তি ২০০ কোটি নিয়ে। কারণ, ক্ষমতায় এসে ওই টাকা দাবি করে বর্তমান রাজ্য সরকার। কিন্তু প্রাপ্য মেনে নিলেও বেহাল আর্থিক দশার কারণে টাকা দিতে না পারার কথা জানিয়ে দেয় হিন্দমোটর। ফলে জমি নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক। যার দরুন প্রকল্পের কাজে এক পা-ও এগোতে পারেনি বেঙ্গল শ্রীরাম।
জট কাটাতে দফায় দফায় বৈঠকের পর শেষ পর্যন্ত গত অগস্টে তিন পক্ষের সমঝোতা হয়। মহাকরণ সূত্রে খবর, মুখ্য সচিব স্তরের বৈঠকে ঠিক হয় যে, প্রথমে পাঁচ কিস্তিতে ২৫ কোটি টাকা ফেরত দেবে হিন্দমোটর। তা ছাড়া বেঙ্গল শ্রীরামের প্রকল্প থেকে লভ্যাংশ বাবদ ৪% অর্থ তাদের প্রাপ্য। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর অনুযায়ী যার পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি টাকা। ফলে ওই টাকা থেকে বাকিটা মিটিয়ে দেওয়ার কথা দেয় হিন্দমোটর। এ জন্য রাজ্যের কাছে ৪০ একর জমি জমা রাখার প্রতিশ্রুতি দেয় বেঙ্গল শ্রীরামও।
আর এই গোটা জটে আটকে রয়েছে বেঙ্গল শ্রীরাম হাইটেক সিটি প্রকল্প। সংস্থার আশঙ্কা, এ ভাবে সময় নষ্ট হলে হিন্দমোটরের কাছে আর পয়সা ফেরত পাবে না রাজ্য। কারণ এ বছরের গোড়ায় তাদের পরিচালন পর্ষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে মূল সংস্থা থেকে চেন্নাইয়ের কারখানা পৃথক করার। ওই কারখানা হিন্দমোটর ফিনান্স নামে শাখা সংস্থার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে। ফলে চালু কারখানা পৃথক হওয়ায় আরও খারাপ হবে সংস্থার আর্থিক হাল। তখন বকেয়া টাকা পাওয়াই সমস্যা হবে। ফলে সে ক্ষেত্রে প্রকল্প আরও জটিলতার মুখে পড়বে বলে বেঙ্গল শ্রীরাম কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর, নিজেদের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে সংস্থা ভাগের ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি পথে যেতে পারে রাজ্য। |