ফজলি, ল্যাংড়ার সঙ্গে আম বাঙালির ঘোর আলাপ। গোলাপখাস, হিমসাগর, মতিহারি, চেনা হয়ে গিয়েছে তাও। সেই তালিকায় নব্য সংযোজন সুজাতা।
ইতিমধ্যেই তা পুরস্কৃতও। শান্তিপুরের আম্রপালি প্রজাতির আম ইতিমধ্যেই পরিচিতি পেয়েছে। এ বার নদিয়ার সেই প্রান্তিক জনপদেই নতুন এক প্রজাতির উদ্ভাবন ঘটালেন প্রভাতরঞ্জন দে। শান্তিপুরের ওই কৃষককে ‘প্ল্যান্ট সেভিয়ার ফার্মার রিওয়ার্ড ২০১২’ দিয়ে স্বীকৃতিও দিয়েছে কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রক। প্রোটেকশন অব প্ল্যান্ট ভ্যারাইটিস অ্যান্ড ফার্মার্স রাইট অথরিটি-র পক্ষ থেকে গত মে মাসে তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়েছে, আর্থিক মূল্য এক লক্ষ টাকা।
ওই সংস্থার যুগ্ম রেজিস্ট্রার বিপল রায়চৌধুরী বলেন, “আমের জগতে নতুন অতিথি সুজাতা। হিমসাগর-ফজলির পরাগ মিলনে ওই আম শুধু সুস্বাদু নয়, দীর্ঘ দিন ধরে তাকে সংরক্ষণও করা যায়।”
প্রভাতবাবুর বাড়ি শান্তিপুরের উমাকান্তপুরে। ছোট থেকেই প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। অষ্টম শ্রেণির পর আর ইস্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কাজ করতেন উষাগ্রামের একটি ট্রাস্টি বোর্ডের নার্সারিতে। সেখানেই হাতে-কলমে শিখে ফেলেন গাছে কলম তৈরির কাজ। এবং সঙ্কর প্রজাতির ফল ফলানোর বিভিন্ন পদ্ধতি। পরিচিতি ছড়িয়ে পড়তে ফুলিয়া কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র-সহ এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাতে কলমে কাজ শেখানোর জন্য ডাকও পড়তে থাকে তাঁর। সেই নিবিড় কলম-সাধনারই ফসল সুজাতা। |
‘সুজাতা’ আমের পরিচর্যায় প্রভাত দে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য। |
ঠিক কী ভাবে জন্ম হল সুজাতার? ১৯৮৯ সালে প্রভাতবাবু ঠিক করেন, হিমসাগর ও ল্যাংড়া আমের পরাগ-মিলন ঘটিয়ে তৈরি করবেন নতুন প্রজাতির আম। শুরু হল পরীক্ষা-নিরীক্ষা। হিমসাগরকে ‘স্ত্রী-আম’ এবং ল্যাংড়াকে ‘পুরুষ-আম’ ধরে টানা তিন বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে পরাগ সংযোগ ঘটালেন তিনি। অবশেষে এসেছে সাফল্য। মুকুলে এল গুটি। সেই আমের গুটি থেকে অবশেষে আম হল। এ বার সেই আমের আঁটি পোঁতা হল মাটিতে। আঁটি থেকে হল গাছ। ছ-বছর পর সেই গাছেই ফল ফলেছে।
প্রভাতবাবু জানান, ছ’টি গাছ পোঁতা হয়েছিল। তার মধ্যে যে গাছে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের আমের ফলন হল, সে গাছটিকে চিহ্নিত করা হল। এর পর সেই গাছে আম্রমুকুল বা ‘সায়ন’ বাছাই করে কেটে অন্য একটি আঁটির গাছের সঙ্গে যুক্ত করে কলম বাঁধা হল নতুন জাতের আম সুজাতা-র চরিত্র ধরে রাখার জন্য। এই ভাবে অঙ্গজ জননের মাধ্যমে তৈরি হওয়া নতুন জাতের আমের চারা তিনি বিলিয়ে দিয়েছিলেন বেশ কয়েক জনের মধ্যে। বারো বছর পরে সে গাছেই ফল ফলেছে।
গুণাগুণ বিচারের জন্য নতুন জাতের আম পাঠানো হয়েচিল বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রভাতবাবু বলেন, “পুরস্কার পাওয়ার আগে আমাকে কেউই তেমন গুরুত্ব দিতেন না। বিভিন্ন দফতরের কর্মী আধিকারিকরা বিদ্রুপ করতেন।” এই সময়ে আলাপ হয় ফুলিয়া কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সহ-অধিকর্তা (প্রশিক্ষণ) অনুপম পালের সঙ্গে। তাঁরই উদ্যোগে নিজের আবিষ্কারের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য উদ্যোগী হন প্রভাতবাবু। অনুপমবাবু বলেন, “হিমসাগর ও ল্যাংড়া আমের মধ্যে সাধারণত পরাগ মিলন হয় না। প্রভাতবাবু সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছেন।”
বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানপালন বিভাগের প্রাক্তন প্রধান রবিশঙ্কর ধুয়া বলেন, “যে-কাজে গবেষকরা গবেষণাগারে পরীক্ষ করে সাফল্য পানসেই কাজই প্রভাতবাবু সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে মাঠে গাটে ফল ফলিয়ে সফল হয়েছেন।” তিনি জানান, আমটি নানা দিক দিয়ে হিমসাগরের থেকে উন্নত মানের। এর মিষ্টতা অনেক বেশি। দ্রবণীয় সুক্রোজের পরিমাণ বেশি। এমনকী, হিমসাগরের থেকে সহনশক্তিও বেশি। তাই সহজে নষ্ট হবে না। হিমসাগরের মতো সহজে নরমও হয় না।
কিন্তু আমের নাম ‘সুজাতা’ কেন? প্রভাতবাবু বলেন, “বোধিবৃক্ষের নীচে তপস্যার সময় গৌতমবুদ্ধ যে-গোপকন্যার হাতে সুমিষ্ট পায়েস খেয়ে বল পেয়েছিলেন, তাঁর নাম সুজাতা। আমার বিশ্বাস, আমার আম সেই পায়েসের মতোই সুস্বাদু হবে!” |