সময়টা আশির দশক। রাজনৈতিক সংঘর্ষে উত্তাল নবদ্বীপ শহর। আইনশৃঙ্খলার অবনতি এতটাই যে, বিধানসভায় চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছিল এই শহর। গোটা শহর অসংখ্য এলাকায় বিভক্ত। উত্তরের বাসিন্দার দক্ষিণে প্রবেশ নিষেধ। পূর্বে কোনও মতেই যাওয়া চলবে না পশ্চিমে। যখন-তখন বোমা-বাজি। শহর জুড়ে থাকত থমথমে পরিবেশ।
অশান্ত শহর নিয়ে তিতিবিরক্ত নবদ্বীপবাসী শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘নবদ্বীপ শান্তি কমিটি’। আটের দশকের সেই শান্তি কমিটিতে রাজনৈতিক মতামত নির্বিশেষে সকলেই সামিল হয়েছিলেন। প্রয়াত অধ্যাপক নৃপেন্দ্রনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, চিকিত্সক কানাইলাল সাহা, ব্যবসায়ী অচিন্ত্য পোদ্দার-সহ বহু জনের সক্রিয় সহযোগিতায় গড়ে ওঠা শান্তি কমিটির হাত ধরে সত্যি সত্যিই নবদ্বীপ শান্ত হয়ে ছিল। নবদ্বীপের ইতিহাসে সুশীল সমাজে পদক্ষেপ নজিরবিহীন ভূমিকা পালন করেছিল। তারও আগে সময়টি ১৯৭৩। রাজ্যে জরুরি অবস্থা চলছে। মন্দার মধ্য দিয়ে চলছে নবদ্বীপের সাংস্কৃতিক জগত্। তখন যাবতীয় রাজনৈতিক মতপার্থক্য দূরে সরিয়ে রেখে নবদ্বীপের সুশীল সমাজের মানুষ গড়ে তুলেছিলেন ‘নবদ্বীপ নাট্য উত্থান পরিষদ’। নদিয়া জেলা তথা এ রাজ্যের অন্যতম প্রাচীন নাট্য সংস্থা। যা আসলে বহু দলের একটি যৌথ মঞ্চ, আজও সমান ভাবে সক্রিয়।
কিন্তু তার পর গুজরাত দাঙ্গা, সফদর হাশমি হত্যা, নন্দীগ্রাম কাণ্ড, শাহবাগ আন্দোলন বা দিল্লির গণধর্ষণ নিয়ে পথে নেমেছেন এখানকার সুশীল সমাজ। মিটিং-মোমবাতি মিছিল, গান, কবিতা প্রতিবাদ সবই হয়েছে।
অনেক দূরবর্তী কোনও এলাকার, ভিন রাজ্যের কোনও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই সব প্রতিবাদে যতটা আগ্রহ দেখা যায়, নিজের চারপাশের হাজারো সমস্যা নিয়ে ততটা প্রতিবাদী হতে পারছেন সেই সুশীল সমাজ?
সাম্প্রতিক কালে চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে কী ভাবছেন প্রাচীন এই শহরের সুশীল সমাজ? কলকাতার দেখানো পথেই হাঁটতে চান কেন তাঁরা। অনেক বিখ্যাত মানুষ, বহুচর্চিত কোনও ঘটনা ব্যতীত তাঁদের পথে দেখা যায় না কেন? দিল্লির ঘটনা, বাংলাদেশের আন্দোলন তাদের আলোড়িত করে। অথচ নিজের জেলা গেদের ঘটনা নিয়ে তাঁরা পথে নামেন না। কেন?
উত্তরে সেই শান্তি কমিটির অন্যতম সদস্য এবং নবদ্বীপ নাট্য উত্তরণ পরিষদের প্রথম সভাপতি অচিন্ত্য পোদ্দার বলেন, “তখন যাঁরা পথে নেমেছিলেন তাঁরা নিজের ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করেছিলেন। সেখানে রাজনীতি বাধা হয়নি। আজ পরিস্থিতিটা পাল্টে গিয়েছে।”
কবি সুব্রত পাল বলেন, “আটের দশকে নবদ্বীপে সুশীল সমাজ বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে। কিন্তু এখন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হইচই ফেলা কিছু ঘটনা নিয়েই কেবল পথে নামার উদ্যোগ হয়। স্থানীয় ভাবে কোনও আন্দোলনে নামা মুশকিল। নবদ্বীপে সবাই সবাইকে চেনেন। বেশির ভাগ মানুষের পেশা ব্যবসা। ব্যক্তিগত সম্পর্ক বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখানে ভাল। ফলে স্থানীয় বিষয়ে এখানে আন্দোলন হয় না।”
অবশ্য অন্য মত নবদ্বীপ নাগরিক কমিটির সম্পাদক দিলীপ চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি বলেন, “এই সময়ের নবদ্বীপের সুশীল সমাজের কথা যদি বলেন, তা হলে আমি বলব, তাঁরা গা বাঁচিয়ে চলতে ভালবাসেন। সবাই নিরাপদে থাকতে চান।”
কবিয়াল নীতীশ রায়ের কথায়, “নবদ্বীপের মানুষের আচরণ আর পাঁচ জায়গার মতো গতানুগতিক নয়। তবে সুশীল সমাজকে আন্দোলন করতে গেলে যতটা রাতনীতি সচেতন হতে হয়, নিজেকে যতটা ওজনদার হতে হয়, তেমনটা কই।” তবে সেই সঙ্গেই তাঁর বক্তব্য, “এখানকার সুশীল সমাজ যতটা সামাজিক নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত, ততটা আন্দোলনের সঙ্গে নন।” নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেবের অবশ্য সোজা কথা, “এখন সুশীল সমাজের রাজনীতিকরণ হয়ে গিয়েছে। যেখানে পথে নামলে রাজনৈতিক চাপ আসতে পারে, সে সব জায়গা সুশীল সমাজ সব রকম ঝামেলা এড়িয়ে চলে। ঘরের সমস্যা থেকে চোখ সরাতে আমরা দেখি অন্য রাজ্যের ঘটনাকে।” |