ব্রাজিলের মাঠে হলুদ ঝড়, পথে বদলের ডাক
মারাকানা স্টেডিয়াম তখন জয়ের রঙে হলুদ। বাইরে পুড়ছে রিও, বিক্ষোভের আঁচে!
স্পেনের পেনাল্টি বক্সের কোণ থেকে নেওয়া বাঁ পায়ে গোলার মতো শট। ক্যাসিয়াসকে কার্যত দাঁড় করিয়ে রেখে জড়িয়ে দিল জালে। গর্জে উঠল ময়দান নেইমার!!! সে গর্জনে কোথায় যেন চাপা পড়ে গেল স্টেডিয়ামের বাইরে লক্ষ মানুষের গলা ফাটানো চিৎকার দুর্নীতি চলবে না, ভাল স্কুল চাই, ভাল হাসপাতাল চাই।
শেষ হল কনফেড কাপ। বিশ্বজয়ীকে ৩-০ গোলে হারাল ব্রাজিল। সামনের বছরই ফিফা বিশ্বকাপের উদ্যোক্তা তারা। আর দু’বছর কাটতে না কাটতেই ২০১৬-তে অলিম্পিক। জলের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি ডলার। অথচ ন্যূনতম সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত দেশের মানুষ। তাঁদের মুখ বন্ধ করতে উঠে পড়ে লেগেছে প্রশাসন। ফুটবল মাঠে জন্ম নিচ্ছে তারকা নেইমার দ্য সিলভা স্যান্তোস জুনিয়র। পথে তখন কাঁদানে গ্যাস, পুলিশের লাঠি, বিপ্লব।
নেইমারদের ছোঁয়ায় জয়ের আনন্দে মারাকানা স্টেডিয়াম যখন উত্তাল, বাইরে রিও-র
রাজপথ তখন প্রতিবাদে উত্তাল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে, সুস্থ পরিবেশ, শিক্ষার দাবিতে।
“জানি এক রাতে সব কিছু বদলে যাবে না”, বললেন ৫৪ বছর বয়সী এলিয়েন মিলাজো। মেয়ে-জামাইকে নিয়ে পথে নেমেছেন তিনি। “যত দিন না বদল আসে, এ ভাবেই পথে নামব বারবার। পথে নামবে আমার পরিবারও।” স্থানীয় আয়োজক কিংবা ফিফা কর্তারা, বিক্ষোভ-আন্দোলন নিয়ে চিন্তিত দু’মহলই। শুক্রবার ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটারের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ‘‘কী ভাবছেন?” উত্তর মেলেনি।
গত কাল স্টেডিয়ামের কাছেই যখন কাঁদানে গ্যাস চলছিল, ব্রাজিল-স্পেন ফাইনাল ম্যাচের বাতাসেও পোড়া গন্ধটা ভেসে এসেছিল। ফের করা হল একই প্রশ্ন, ‘‘কী ভাবছেন?”
এ বারেও ফিফা নিরুত্তর।
ব্রাজিলে বিক্ষোভ শুরু জুন মাসে প্রায় কনফেড কাপের হাত ধরেই। সমলোচকরা বলছেন, ইচ্ছে করেই আন্দোলনকারীরা এই সময়টা বেছে নিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রচার পাওয়া যাবে তাই। প্রচার মিলেওছে। কখনও বা ছাপিয়ে গিয়েছে ম্যাচের উত্তেজনা। সৌজন্যে অবশ্য পুলিশ-প্রশাসন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মারধর করেছে পুলিশ, রবার বুলেট চালিয়েছে, কখনও বা মুখের সামনে স্প্রে করে দিয়েছে লঙ্কার গুঁড়ো। অত্যাচারের সীমাই দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশি সংবাদপত্রের শিরোনামে এনেছে পেলের দেশকে।
তবে প্রচারের কথাই যদি বলা হয়, আট দেশের কনফেড কাপ তো বিশ্বকাপের মহড়া মাত্র। এ বারেই বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে বেশ কয়েক জন খেলোয়াড়-কোচকে। পরিস্থিতি সামলাতে তড়িঘড়ি মঞ্চে উঠেছিলেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রোউসসেফ। দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, সাধারণ মানুষের ক্ষোভ দূর করার সব রকম চেষ্টা করবে সরকার। কিন্তু একই সঙ্গে দেন হুঁশিয়ারিও— বিক্ষোভের নামে সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর কিংবা লুঠতরাজ কিছুতেই বরদাস্ত করা হবে না। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়া এক সময়ের গেরিলা নেত্রীর থেকে এ হেন প্রতিক্রিয়া পেয়ে অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন, “টিভি-র পর্দায় দিলমা আমাদের বোকা বানাচ্ছেন।”
পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের মুখে বিক্ষুব্ধ জনতা। স্টেডিয়ামের বাইরে রবিবার। ছবি: এপি
রবিবার রিও-র পথে তানিয়া নবরেগা নামে এক মনোবিদ বললেন, “মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠেছে। কী অবস্থা হাসপাতালের! স্কুলগুলো বীভৎস।” দিলমার উপর আলাদা করে রাগ নেই তানিয়াদের। তাঁর কথায়, “শুধু শাসক দল নয়, কোনও রাজনৈতিক দলের উপরই আমাদের আর ভরসা নেই। হতাশ হয়ে গিয়েছি।”
ফুটবলের পরে ব্রাজিল বলতে অনেকেই ভাবেন, ‘বিচ-পার্টি’। সমুদ্রের ধারে বালিতে শুয়ে রোদ পোয়ানো, সাম্বা নাচ আর রাতভর পার্টি। কিন্তু বাস্তবটা একেবারেই উল্টো। ঘাড় পর্যন্ত করের বোঝা, সরকারি ব্যবস্থাপনা চূড়ান্ত খারাপ। অথচ রাশিয়া-ভারত-চিন-সাউথ আফ্রিকার সঙ্গে ‘ব্রিকস’ গোষ্ঠীতে রয়েছে ব্রাজিল। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বলছে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা উর্ধ্বমুখী। তা হলে দেশবাসীর অবস্থা এমন করুণ কেন? রবিবার স্টেডিয়ামের বাইরে মুখগুলো বারবারই উস্কে দিচ্ছিল প্রশ্নটা।
আজ কনফেড কাপের শেষে বদলে যায়নি ব্রাজিল। দেশের আনাচে কানাচে নেইমারের জয়ধ্বনি। খেলা শুরুর আগে প্রশ্ন উঠেছিল, নেইমারকে নিয়ে বাড়াবাড়ি হচ্ছে না তো? ২১ বছরের যুবক মুখের উপর জবাব ছুড়ে দিয়েছেন। অসাধারণ গোল, দুর্দান্ত পাস। রোমারিও, রোনাল্ডো, এমনকী পেলের সঙ্গে তাঁকে এক আসনে বসানো যায় কি না, তা নিয়ে ঝড় উঠেছে বিশেষজ্ঞ মহলে। কিন্তু এই ব্রাজিলীয় তরুণই এক দিন বলেছিলেন, “আমি ব্রাজিলীয়। আমার পরিবার, বন্ধুরাও এ দেশেই থাকে। তাই আমিও এমন এক ব্রাজিল চাই যা অনেক বেশি নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর এবং সৎ।”
দিলমা হয়তো এখন স্বপ্ন দেখছেন টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই থিতিয়ে পড়বে বিক্ষোভ। মিলিয়ে যাবে স্লোগান। প্ল্যাকার্ডগুলো জায়গা পাবে বাড়ির স্টোর রুমে। কারণ ক্যামেরা-ট্রাইপড গুটিয়ে বিদেশি সাংবাদিকদের এখন দেশে ফেরার পালা। বিক্ষোভ দমনের এই সুযোগ। রবিবারের বিক্ষোভ নিয়ে রা-ও কাড়েননি তিনি। তবে কনফেড জয়ের পরে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শুভেচ্ছাবার্তার জবাব দিতে ভোলেননি। জানিয়েছেন, “আমাদের খেলোয়াড়রা দারুণ উপভোগ করেছেন, একতা দেখিয়েছেন, ফুটবলে এনেছেন সৃজনশীলতার ছোঁয়া। সবশেষে জয় করে নিয়েছে ব্রাজিলের মন। আর বিশ্বকে উপহার দিয়েছে এক অসাধারণ ক্রীড়া প্রদর্শনী।”
দিলমা জানেন না, স্টেডিয়ামের বাইরেও নজর রাখছে বিশ্ব।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.