প্রবন্ধ...
বিবেক সাড়া দেয়নি বলেই অনেকে হাঁটেননি
পার্থ চট্টোপাধ্যায় (‘মিছিলে কারা হাঁটলেন...’, ২৫-৬) লিখেছেন, বামফ্রন্টের সমর্থকদের সঙ্গে মিছিলে হাঁটব না বলেই মিছিলের আগের দিন, ২০ জুন, কলেজ স্কোয়ারে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। আসলে কিন্তু কামদুনি-সহ পর পর একাধিক নারীনিগ্রহ-ধর্ষণের ঘটনায় বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিবাদ নানা স্তরে, নানা জনের উদ্যোগে নানা স্থানে হচ্ছিল। শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মী-বুদ্ধিজীবী মঞ্চের অনুষ্ঠানটি তারই একটি অংশ ছিল। আমি এই সভায় ছিলাম। তবে, নানা গুণিজনের বক্তৃতায় পক্ষে-বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত হয়েছিল। অনেকে মিছিলে যোগও দিয়েছিলেন। ‘মিছিল-বিরোধী’ কোনও সিদ্ধান্ত সেই সমাবেশ থেকে নেওয়া হয়নি।
পার্থবাবুর মনে হয়েছে, মিছিল ছিল ‘অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত’। যদিও যত দূর জানি, এপিডিআর ও কিছু গণ সংগঠন এই মিছিলের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয় ও শঙ্খ ঘোষ-সহ অনেকের স্বাক্ষরিত বিবৃতি মিছিলের চার-পাঁচ দিন আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। দু’তিনটি চ্যানেল তা কয়েক দিন ধরে প্রচারও করে আসছিল। তাই, মিছিলে যোগদানের আহ্বানের পিছনে একটা সংগঠিত শক্তির (যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন) উদ্যোগ ছিল। মিছিলের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই সংগঠিত শক্তির প্রভাবাধীন নাগরিকরা ছিলেন।
এই মিছিলের চরিত্র, উদ্দেশ্য নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই। প্রশ্ন অন্যত্র। পার্থবাবু বলেছেন, নন্দীগ্রামে, সিঙ্গুরে ‘নীরব থাকা’ মানুষদের রাজনৈতিক সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে অসংখ্য ‘নীরব থাকা মানুষের’ সততা-নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন আদৌ তোলা হয়নি। প্রশ্ন তোলা হয়েছিল তাঁদের সম্পর্কে, যাঁরা নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর (এবং লালগড়) ঘটনাগুলোর পুরো পর্ব জুড়ে সক্রিয় ভাবে গানে, কবিতায়, তথ্যচিত্রে, ভাষণে, টক শো-তে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে সমর্থন করেছিলেন, নারীনিগ্রহ থেকে শুরু করে ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে অস্বীকার করেছিলেন। এবং তাঁদের সম্পর্কেও, যাঁরা তাপসী মালিকের বাবা-ই তাপসীর ধর্ষক বলে নাটক লেখা, প্রচার করা, তৃণমূলরাই নন্দীগ্রাম থেকে সিঙ্গুরের ঘটনায় ধর্ষক বলে প্রবন্ধ লেখা, সুহৃদ দত্তের সাজা হওয়া সত্ত্বেও তাকে আড়াল করা, নন্দীগ্রামে ধর্ষিতা-নির্যাতিতাদের ক্ষতিপূরণ না-দেওয়ার চেষ্টাকে সমর্থন করা, লালগড়ে যৌথবাহিনীর হাতে ধর্ষিতা আদিবাসীদের নিরাপত্তা দিতে অস্বীকার করা, দোষী ধর্ষক, পুলিশ-হার্মাদদের শাস্তি না দিয়ে বরং বলা, ‘জঙ্গলমহলে যৌথবাহিনী সাফল্য পেয়েছে’ এর সমর্থক ছিলেন।
ডেভিড আরভিং-এর মতো কুখ্যাত সমাজবিজ্ঞানীরা চেষ্টা করেছিলেন ফ্যাসিবাদের দ্বারা কৃত ‘Holocaust’কে অস্বীকার করার, মিথ্যা প্রচার হিসেবে দেখানোর। অনেকে চেষ্টা করেছেন, ক্রুশ্চেভ বর্ণিত ‘গোপন রিপোর্ট’-এ উল্লিখিত একটি ঘটনার জন্যও স্তালিন দায়ী নন, প্রমাণ করতে। ছোট ক্যানভাসে যাঁরা এই ‘Politics of Denial’-এর চেষ্টা করেছিলেন, ধর্ষণকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার বামফ্রন্ট সরকারের নীতির সপক্ষে যাঁরা সরব হয়েছিলেন, বা যে সমস্ত প্রতিবাদী মানুষের কলম ক্ষেত্রবিশেষে গর্জে ওঠে, আবার ক্ষেত্রবিশেষে সিন্দুকে বন্ধ থাকে; যাকে ফরাসি দর্শনবিদ অ্যালেন বাদিউ-এর পরিভাষায় বলা যেতে পারে ‘inhuman element of human being.’ তাদের নিয়েই শুধু প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। অনুশোচনা অনুতাপে দগ্ধ না হয়ে যদি কেউ পূর্বের মতোই অস্বীকার করে অতীতকে, তা হলে তার ছদ্ম- নৈতিকতার প্রসঙ্গ তোলা, নাগরিকদের মহতী মিছিলে চোরাবালির অস্তিত্ব সম্পর্কে সতর্ক করা অন্যায়, অপরাধ?
‘পরিবর্তন’ যাঁরা চেয়েছিলেন, তাঁদের বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টি নিয়ে পার্থবাবু প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু দু’বছর আগের রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে যখন এক দিকে বামফ্রন্ট শাসনের নৈতিক ভিত্তি তলানিতে এসে ঠেকেছিল এবং অন্য দিকে সেই অপশাসন, স্থিতাবস্থার ব্যাধি থেকে মানুষ মুক্তি চেয়েছিল, তখন অন্য কোনও অবলম্বন কারও ছিল না। যা ছিল, তার সম্পর্কে যেমন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও ঝুঁকি ছিল, তেমনই ছিল বিপুল সম্ভাবনা, সুপ্রশাসন দেওয়ার প্রশ্নে। বিপুল সেই সম্ভাবনার সব হাতিয়ার মজুত ছিল: ইতিহাসের শিক্ষা, নানা স্তরের মানুষের তীব্র প্রত্যাশা, আকাঙ্ক্ষা, সামাজিক-নাগরিক আন্দোলনের দাবি, সুপ্রশাসন দেওয়ার সুযোগ। এবং এগুলো প্রতিফলিত হয়েছিল ২০১১ সালের তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহারে। আর উলটো পিঠে কী ছিল? বামফ্রন্ট শাসনের আরও পাঁচ বছর। জনসমর্থনে ‘পুষ্ট’ হয়ে আরও নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর-লালগড়-নেতাই ঘটত, আর আমরা তা প্রত্যক্ষ করতাম!
হেগেলের নির্ভুল পর্যবেক্ষণটি কেউ না মানলে আবার পট-পরিবর্তন হবে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়ায় জনতা পার্টিকে আড়াই বছরের মাথায় বিদায় নিতে হয়। স্বৈরাচারী মোবারককে সরাল ‘আরব বসন্ত’। নতুন শাসক এসে অন্যায় শুরু করল। মানুষ আবার আন্দোলনে নামল।
১৯৭৮ সালের বন্দিমুক্তি ও জনদাবি (প্রস্তুতি) কমিটির ডাকে দেশপ্রিয় পার্ক থেকে বন্দিমুক্তির সমর্থনে মিছিলের কথা পার্থবাবু বলেছেন ও তুলনা করেছেন। কিন্তু এই তুলনা কি যথাযথ? আটাত্তরের সেই মিছিলে সমস্যাটা ছিল আয়োজকদের। হয়তো কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় মিছিলে হাঁটতে চেয়েছিলেন নিজের অতীত ভুলের সংশোধন করার জন্য। তাঁর সমর্থনপুষ্ট সরকার যাদের বন্দি করে রেখেছিল, তাদের মুক্তির দাবির মধ্য দিয়ে। শুক্রবারের মিছিলে ‘বিতর্কিত’ ব্যক্তিদের সে রকম কোনও ইচ্ছা ছিল না। ২১ জুন আয়োজকরা আগেই জানিয়েছিলেন, মিছিলের দ্বার সকলের জন্য অবাধ। ব্যাপারটা ২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বরের মতোও নয়। সেখানে কয়েক জন বলেছিলেন, অমুক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হাঁটলে আমরা হাঁটব না। দুই, সি পি আই তখন সবে ইন্দিরা কংগ্রেসের গাঁটমুক্ত হয়েছে এবং জোটবদ্ধ অবস্থাতেই সিপিআই বার বার নকশাল দমন, লালবাজারে অত্যাচার নিয়ে সংসদে বা অন্যত্র সরব হয়েছিল। যেমন, বামফ্রন্টের আমলে, নন্দীগ্রাম পর্ব থেকে শরিক দলগুলি বার বার সি পি এমের রাষ্ট্রীয় দমন নীতির সমালোচনা প্রকাশ্যে করেছে। এখানে সমস্যা তাই আয়োজকদের নয়, ছিল অংশগ্রহণকারীদের। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের বিবেক থেকে সাড়া পাননি ‘denialist’দের সঙ্গে হাঁটতে। সে অধিকার তো পার্থবাবু অস্বীকার করেননি! তা হলে সমালোচনা কেন?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.