বিচারবিভাগের উপর ভারতীয় সমাজের বিশেষ ভরসা আছে, ভরসার কারণও আছে। গণতান্ত্রিক আদর্শ এবং সেই আদর্শের অনুসারী আচরণ নিশ্চিত করিতে বিভিন্ন উপলক্ষে আদালত এ দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিয়াছে। সেই সূত্রে হয়তো বিচারবিভাগের আচরণে অনেক সময় অতিরিক্ত সক্রিয়তাও দেখা গিয়াছে। এমন অনেক বিষয়ে আদালত মাথা ঘামাইয়াছে, যাহা শাসনবিভাগের কাজ। কখনও বা কোনও বিষয়ে রায় বা নির্দেশ দিতে গিয়া বিচারপতিরা এমন অনেক মন্তব্য করিয়াছেন, যাহা হইতে বিরত থাকাই হয়তো শ্রেয় ছিল। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে, তৃতীয় বিশ্বের অন্য অনেক দেশের সঙ্গে তুলনা করিলে অথবা ভারতেরই, সংসদ সহ, অন্য বিবিধ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয়ের সহিত তুলনা করিলে বিচারালয় আপন মর্যাদা অনেকখানি অক্ষুণ্ণ রাখিতে পারিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। গত সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন সংক্রান্ত মামলার বিচারে সুপ্রিম কোর্ট সেই ধারাতেই একটি নূতন দৃষ্টান্ত স্থাপন করিল। কলিকাতা হাইকোর্টে যে বিবাদ লইয়া দীর্ঘ টানাপড়েন চলিয়াছে, সর্বোচ্চ আদালত তাহা দুই দিনের মধ্যে মীমাংসা করিয়া দিল। এবং যে তৎপরতা ও দৃঢ়তার সহিত কাজটি সম্পন্ন করিল, তাহাকে অসামান্য বলিলে অত্যুক্তি হয় না। যে যুক্তিতে বিলম্বিত বিচার অবিচারের শামিল, সেই যুক্তিতেই দ্রুত বিচার সুবিচারের সমার্থক। সুপ্রিম কোর্টকে অভিবাদন।
সুপ্রিম কোর্ট যে সমস্ত তথ্যের ভিত্তিতে যে প্রশ্নের মীমাংসা করিয়াছে, কলিকাতা হাইকোর্টের সামনেও তাহাই প্রস্তুত ছিল। অথচ সপ্তাহের পর সপ্তাহ মামলা চলিয়াছে, নূতন নূতন সমস্যার উদয় হইয়াছে, ক্রমাগত আশঙ্কা বাড়িয়াছে যে, সমগ্র নির্বাচনী প্রক্রিয়াটি বুঝি বিশ বাঁও হইতে চল্লিশ বাঁও জলে ডুবিল। সন্দেহ নাই, এমন বিবাদ আদৌ না হওয়াই কাম্য। সন্দেহ নাই, রাজ্য প্রশাসনের অহেতুক কলহপরায়ণতা সমস্যা বাড়াইয়া তোলে। কিন্তু নির্বাচন আয়োজনে কাহার এক্তিয়ার কতখানি, সেই প্রশ্ন যখন উত্থাপিত হইয়াছে, তখন আইন ও সংবিধানের প্রত্যক্ষ নির্দেশ এবং নিহিত আদর্শ অনুসারে প্রশ্নের সুস্পষ্ট মীমাংসাই আদালতের নিকট প্রত্যাশিত ছিল। কলিকাতা হাইকোর্টের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রাখিয়াই, বস্তুত বিশেষ করিয়া সেই শ্রদ্ধার প্রণোদনাতেই খেদের সহিত বলিতে হয় যে, উচ্চ আদালত প্রায় দুই মাস ধরিয়া সেই প্রত্যাশা পূরণ করেন নাই বা করিতে পারেন নাই। মামলার বিভিন্ন স্তরে বিচারপতিদের কথা শুনিয়া মনে হইয়াছে, তাঁহারা কেন আপন প্রত্যয়ী সিদ্ধান্ত স্থির করিয়া কঠোর ভাবে তাহা ঘোষণা করিতেছেন না? সুপ্রিম কোর্টের দ্রুত, দৃঢ় এবং কঠোর মীমাংসার পরে আজ যদি কেহ হাইকোর্টের বিচারপ্রক্রিয়াটির প্রতি সিংহাবলোকন করেন, তবে এই প্রশ্ন আরও বড় আকারে দেখা দিবে না কি?
লক্ষণীয়, পঞ্চায়েত নির্বাচন বিষয়ে বামফ্রন্ট সরকার প্রণীত আইনে কমিশনের এক্তিয়ার তথা অধিকারকে দ্ব্যর্থহীন ভাবে নিরঙ্কুশ করিয়া দেওয়া হয় নাই, রাজ্য সরকার ও কমিশনের ‘পরামর্শ’র ছিদ্র রাখা হইয়াছে, সেই ছিদ্রপথেই বিবাদ প্রবেশ করিয়াছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেও এই মূলগত রন্ধ্রটি থাকিয়াই গেল, ভবিষ্যতে আবারও এমন বিবাদের আশঙ্কা অন্তর্হিত হইল না। এই মামলার নির্দিষ্ট প্রেক্ষিতে, বিশেষত দ্রুত মীমাংসার প্রয়োজনে, সর্বোচ্চ আদালতের পক্ষে হয়তো ইহার অধিক সম্ভব বা সংগত ছিল না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ হইতে অন্তত এই ক্ষেত্রে স্পষ্ট হইয়াছে যে, নির্বাচন আয়োজনে কমিশনের ভূমিকাই প্রধান। ইতিপূর্বে একাধিক রাজ্যে স্থানীয় নির্বাচন সংক্রান্ত বিবাদের মীমাংসা করিতে গিয়াও সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল। কলিকাতা হাইকোর্ট যদি সর্বোচ্চ আদালতের সেই পূর্বসিদ্ধান্তগুলির আদর্শ অনুসরণ করিয়া এই মামলাতেও যত দ্রুত সম্ভব কমিশনের অধিকার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রতিষ্ঠা করিতেন, বিচারবিভাগের উপর নাগরিকদের ভরসা আরও জোরদার হইত, সেই ভরসার ভিতটি আরও প্রসারিত হইত। যে কোনও প্রতিষ্ঠানের মতোই বিচারবিভাগের উৎকর্ষও তাহার প্রত্যেকটি স্তরে এবং বিভিন্ন স্তরের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে অনুশীলিত হইবে, ইহাই কাম্য। |