রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
সুমনামি
ডাক হরকরা’ ছবিতে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় ও সুধীন দাশগুপ্তর সুরে যে মান্না দে’কে পেলাম, তিনি যেন আমজনতার ঘরের মানুষ। তাঁর আগলহীন, আড়ষ্টতাহীন স্বরপ্রক্ষেপ, যে-কোনও পরদায় সুর ধরে রাখায় তাঁর দম যেন কায়িক শ্রমে অভ্যস্ত মানুষের ধাঁচা। এ দিক দিয়ে তিনি এক কালের গিরিন চক্রবর্তী ও নির্মলেন্দু চৌধুরীর মতো। ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায়’ গানটির অন্তরা ‘চোখের জলই পাওনা কি হায়’ গাইতে গিয়ে মান্না দে তারসপ্তকের শুদ্ধ গা থেকে সুঠাম দুটি পা ফেলে শুদ্ধ মা ও শুদ্ধ পা-তে চলে যাচ্ছেন এবং তার পর মা ছুঁয়ে শুদ্ধ গা, সেখান থেকে তারের সা-তে আসছেন— মাঝে এক বারও দম না নিয়ে। একই দম অনায়াসে ধরে রেখেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ‘দূরের মানুষ কাছে এসো’ গানটির অন্তরায়। ‘ডাকব না আর ভগবানে’ গাইতে শুরু করছেন তিনি এক লাফে তারের শুদ্ধ মা-তে গিয়ে। সেখান থেকে ‘ভগবানে’ কথাটি গাইছেন গ-ম-প এই তিনটি তারসপ্তকের স্বর একটি মোচড় দিয়ে গেয়ে পা-এ সাত মাত্রার তালের একটা গোটা আবর্তন ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে। তাঁর সহজাত স্বরধ্বনি একটুও না খুইয়ে। ‘শেষ বিচারে’র অন্তরাতে অত উঁচু গ্রামেও মান্না দে’র গলা যেন আরও মিঠে।
এই ফাঁকে জীবনে এক বার অন্তত বলে রাখি, ২০০২/৩ সালে এক চলচ্চিত্র এডিটর, অবশ্যই বাঙালি, গান নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমায় বলেছিলেন, ‘হেমন্তদা তো সারা জীবন বেসুরই গেয়ে গেলেন।’— প্রথমত ‘হেমন্তদা’। বক্তা বয়সে আমার চেয়েও ছোট, তার ওপর ‘সারা জীবন বেসুর’ গেয়ে যাওয়া। স্বনামধন্য সেই ব্যক্তিটিকে কেন যে সঙ্গে সঙ্গে ঠাসিয়ে একটা থাপ্পড় মারিনি! এই আত্মগ্লানি থেকে কোনও দিন মুক্তি পাব না।
১৯৬০ সালে ‘বরসাত কি রাত’ ছবিটি যখন মুক্তি পেল, উপমহাদেশ জানতে পারল কাওয়ালি আঙ্গিকে মান্না দে কোন উচ্চতায় উঠতে পারেন। ‘না তো কারওয়াঁকি তলাশ হ্যায়’ গানটি তিনিই ধরছেন। খামাজ রাগে রওশনের সুর। আঙ্গিক কাওয়ালি। যন্ত্রসংগীতের ভূমিকার পর একটি মোক্ষম ঝোঁকের মাথায় তিনি শুদ্ধ গা থেকে মিড় দিয়ে সা-এর মোকামে এলেন। তার পর বিদ্যুৎ গতিতে একটি তান দিয়ে সটান তারের শুদ্ধ গা। সেখান থেকে তারের পঞ্চম ছুঁয়ে একটি অবরোহণ তান একই ক্ষিপ্র গতিতে মোকাম লক্ষ্য করে। তার পর মধ্য সপ্তকের পা, শুদ্ধ মা, শুদ্ধ গা, শুদ্ধ রে— এই স্বরগুলিকে নিয়ে মধুর অভিমানের খেলা। এর পর কথাভিত্তিক গান। খামাজ রাগে যে মুখবন্ধ মান্না দে এই গানের রেকর্ডিং-এ প্রয়োগ করেছেন, তা শুনলে মার্গসংগীতের সেরা শিল্পীরাও তাঁকে কুর্নিশ করবেন। শুধু প্রায়োগিক দক্ষতার প্রশ্ন নয়। মেজাজ।
ছবি: সুমন চৌধুরী
রাজার যে ভাবে রাজ্য শাসন করার কথা, গানের আলাপের ওই অল্প পরিসরে মান্না দে সেই ভাবে শাসন করছেন স্বরগুলিকে। যাকে বা যেটিকে যতটা দেওয়া উচিত, ততটাই দিচ্ছেন— রাজকীয় গরিমায়। কিন্তু ‘না তো কারওয়াঁকি তলাশ’ গানটি ধরার আগে মধ্য সপ্তকে ক’টি স্বর নিয়ে তাঁর গুনগুনানি যেন তাঁর অভিমান, এমনকী তাঁর সমর্পণ। ছেলেবেলায় স্কুলের বাংলা বই-এ পড়া কালীদাস রায়ের একটি কবিতার শেষ দুটি লাইন আমার আজও মনে আছে: ‘সন্ধে হয়ে এল ঐ/ আর কতো বসে রই/ তব রাজ্যে তুমি এসো চলে’।
১৯৮৭/৮৮ সালে এক বার ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। অনেক পীড়াপীড়ির পর তিনি সলজ্জ ভঙ্গিতে, হাত জোড় করে বলেছিলেন, ‘বাবা, বড্ড কম শিখতে পেরেছি। তুমি এতই চেপে ধরেছ, আচ্ছা বেশ, তেমন আর কী, এই ধরো বাইশ-তেইশ ধরনের স্টাইল সামান্য রপ্ত করতে পেরেছি’।— আমার ধারণা, মান্না দে-ও মোটের ওপর অত রকমেরই আঙ্গিকে দখল রাখতেন, সেই বয়স তাঁর যত দিন ছিল। ‘বরসাত কি রাত’ ছবির এই কাওয়ালিতেই তিনি পর্যায়ক্রমে কিছু তান ও ছন্দের খেলা করেছেন, যা প্রতিষ্ঠিত ধ্রুপদী কণ্ঠশিল্পীদের কাজকর্মের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে পাল্লা দিতে পারে।
খেয়াল-ঠুংরি আঙ্গিকে দক্ষতা থাকলে অনেক সময়ে দেখা যায়, শিল্পী সেই দক্ষতা বা ওজন যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানেও প্রয়োগ করে ফেলছেন। কিছু কাল আগেও ছবিঘরে দেখেছি-শুনেছি ভারতের বরেণ্য কণ্ঠশিল্পীরা ভারতের জাতীয় সংগীত গাইছেন। এ-গানের সুর সোজাসাপটা। কোনও কোনও খেয়ালপটু গায়কের বোধ হয় তাতে আঁতে লাগছে, তাই তাঁরা জাতীয় সংগীত গাইতে গিয়েও একটু-আধটু গিটকিরি দিয়ে ফেলছেন, বা সুরটাকে হেলিয়ে-দুলিয়ে দিচ্ছেন। একেই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় (হবি-তো-হ’ তিনিই আবার আমাদের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা) ‘ক্লাসিকিয়ানার মোহ’ বলা যায়।
দুর্ধর্ষ কণ্ঠদক্ষতার অধিকারী মান্না দে’র কোনও কোনও গানে ‘ক্লাসিকিয়ানার মোহ’-র পরিচয় মেলে। তাঁরই চমৎকার সুরে তাঁর গান ‘সেই তো আবার কাছে এলে’-তে যেমন। কথা সুর মিলিয়ে অভিমান হল গানটির মূল আবেগ। অন্তরায় কী আশ্চর্য, একটি মিড় তিনি নিলেন শুদ্ধ গা থেকে শুদ্ধ নি-তে। অকারণ অলঙ্কারের লেশমাত্র নেই। ‘আবার নিজেই দিলে জ্বেলে’ কথাগুলি গাইতে গিয়ে তিনি যখন ওই বিরল অনুচ্চ মিড়ের পর সা-তে ফিরলেন, হারানোর ব্যথায় ফিরে পাওয়ার সুখ মিশে কী অনাস্বাদিতপূর্ব এক পুরুষালি অভিমান যে বেজে উঠল! এই অভিজ্ঞতার পর সঞ্চারীতেই কিন্তু কেমন-কেমন। ‘তুমি তো আমায় ভাল চেনো’র ‘চেনো’-তে শিল্পী হঠাৎ যে ধাক্কা-দেওয়া ওজন ও গলার ঠুংরি-মার্কা কাজটা দিলেন, সেটা মূল মেজাজটাকে নড়িয়ে দিল। ‘তুমি তো আমায় ভাল চেনো/ তুমি ছাড়া কোনও গান ভাবতে পারি না, তা জানো’ এই কথা এবং তার সুরে ওই ওজন ও ঠুংরিফিকেশন অপ্রয়োজনীয়। ক্লাসিকিয়ানার মোহ জাগায়, ব্যাঘাত ঘটায় আধুনিক সাংগীতিক উচ্চারণে। রসের একই ব্যাঘাত ঘটেছে এই গানেরই দ্বিতীয় অন্তরায়: ‘সেই কথা মুখে কেন বলো না’ গেয়ে ‘না’-এর সূত্র ধরে গলার যে ভাঁজগুলো পরপর ফেলা হল, তা এড়াতে পারলে গায়কি আরও আধুনিক হত।
এজরা পাউন্ড তাঁর ‘এবিসি অব রিডিং’ গ্রন্থে প্রস্তাব করেছিলেন: যে শব্দগুলির কোনও কাজ (function) নেই, সেগুলিকে শনাক্ত করো, বাদ দাও।— সংগীত সমালোচনাতেও এই পদ্ধতি কাজে লাগে। খেয়াল-ঠুংরির অতি-প্রভাবে হঠাৎ হঠাৎ অস্থানেও কালোয়াতি উঁকি দিয়ে ফেলে। রবীন্দ্রনাথের ব্যবহার করা আর একটি শব্দ ধার করে বলি: সাবেকিয়ানা। আধুনিক গানে এড়ানো দরকার।
অথচ, কীর্তনভাঙা সুর ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’-এ তাঁর কীর্তন-ঘেঁষা গায়কিতে function-হীন একটি স্বরও নেই। তেমনি তাঁর প্রথম দিকের একাধিক গানে (‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা’, ‘হায় হায় গো’, ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বলো’ ইত্যাদি) আধুনিক গায়কিতে তিনি স্বরাট। একই আত্মনিয়ন্ত্রণের নিদর্শন মান্না দে রেখেছেন সলিল চৌধুরীর কথায়-সুরে ‘মানব না বন্ধনে’, ‘ধন্য আমি জন্মেছি মা তোমার ধূলিতে’, ‘ও আলোর পথযাত্রী’ গানগুলিতে। ঠিকমত ‘গণসংগীত’ গাইতে গেলে কণ্ঠের পূর্ণ দক্ষতা ও পরিশীলন যে অপরিহার্য, মান্না দে তা দেখিয়ে দিয়েছেন। সত্যি বলতে, তাঁর গান গাওয়ার ধরন, বড় গলায় স্বরপ্রক্ষেপ আর স্পষ্ট উচ্চারণ শুনে বার বার মনে হয়েছে, গিরিন চক্রবর্তীর পর তিনি হয়তো ইন্ডাস্ট্রির একমাত্র গায়ক, যাঁকে গণ-গায়ক বলা যায়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.