রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১...
বেওসা
ন্যকে নিয়ে বাঙালি খুব ইয়ার্কি মারতে পারে। মাড়ওয়ারিকে ‘মেড়ো’ বলতে পারলে সে খুশি হয়। আরও খুশি হয় অন্যের দক্ষতাকে তার ডায়ালেক্টেই খাটো করতে পারলে। ব্যবসাকে ‘বেওসা’ বলার কোনও মতে এক পিস সুযোগ পেলে বাঙালির প্রাদেশিক অন্তরাত্মা জুড়োয়। কেননা, নিজে সে চিরকাল বাড়ি থেকে মুখস্থ করে গিয়ে লিখে এসেছে ‘বেকার সমস্যা ও তার প্রতিকার’ শীর্ষক কোটেশনসমৃদ্ধ বাংলা রচনা। তার পর পাশ-টাশ দিয়ে বেকারের সংখ্যা দাঁড় করিয়েছে এক্স প্লাস ওয়ানে। তার পর সুখতলা খুইয়ে চাকরি খুঁজেছে ওই ‘মেড়ো’-র আন্ডারেই। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ব্যবসা শুরু করার মুরোদ তার নেই।
অথচ অনেক বাঙালি দেবতা তাকে চাবকে বলেছিলেন, ব্যবসা ধর! বহু দিন আগে কলেজপাড়ায় বইয়ের দোকান দিয়েছিলেন এক বাঙালি ইন্টেলেকচুয়াল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সংস্কৃত প্রেস অ্যান্ড ডিপোজিটরি। মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে পার্টনার হিসেবে ছাপাখানা বসিয়েছিলেন। সেই ব্যবসা কত দূর সিরিয়াস ছিল, বুঝতে পারা যায় বিদ্যাসাগরের লেখনী থেকেই। তর্কালঙ্কারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এমন জায়গায় পৌঁছয়, তর্কালঙ্কারের মৃত্যুর পর বিদ্যাসাগর ‘শিশুশিক্ষা’-র কপিরাইট বাবদ টাকা মেরে দিয়েছেন, এমন কথাও রটে। রটান তর্কালঙ্কারের জামাই যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ। ব্যবসার এই টানাপোড়েন আইন-আদালত পর্যন্তও গড়ায়। ব্যবসায়ী বিদ্যাসাগর যে ‘পরস্বহারী’ নন, তা প্রমাণ করতে শেষমেশ ‘নিষ্কৃতিলাভপ্রয়াস’ নামক গোটা একখানি পুস্তিকাই লিখে ফেলতে হয় লেখক বিদ্যাসাগরকে। না, ব্যবসা করতে, নিজের ব্যবসায়ী সত্তাকে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে তাঁর প্রেস্টিজে লাগেনি।
লেখক শংকরকে এক বার নাকি তাঁর এক গুজরাতি বন্ধু বলেছিলেন, ‘নিজেদের বেনিয়া বলতে আপনারা অপমান বোধ করেন, অথচ দেখুন মহাত্মা গাঁধীকে, কথায় কথায় নিজের বেনিয়াত্ব ঘোষণা করতেন।’ শংকরের বিশ্বনাথ বোসকে দিয়ে যে-কথা বলিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। ‘তুমি ব্রাহ্মণ সন্তান, তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করতে পার, কিন্তু সওদা করবে কী করে?’ ‘জনঅরণ্য’-র সোমনাথের উদ্দেশে বলেছিলেন ওই বিশুদা। আর এক বছর ধরে চাকরি খুঁজে হয়রান সোমনাথ যখন বাড়িতে জানাল, সে ব্যবসা করবে, তার বাবা মন্তব্য করেছিলেন— ‘এটা যেহেতু মেনে নেওয়ারই যুগ, তুই ব্যবসা করলেও সেটা আমি মেনে নেব।’ বোঝা যায়, বাঙালি মাস্ যেটুকু ব্যবসার দিকে হেঁটেছিল, তার অধিকাংশটাই বাধ্যত। অগতির গতি। একখানি কেরানির চাকরিও যদি তার আগেভাগে জুটত, হার্গিস সে ব্যবসার দিকে পা বাড়াত না।
ব্যবসার প্রতি বাঙালির এই দৃষ্টিভঙ্গির কথা সম্প্রতি ফের উঠে এল ‘গয়নার বাক্স’ ছবিতে। ঠাটবাট বজায় রাখতে গিয়ে যখন জমিদার বংশের ঘটিবাটি বেচা চলছে পুরোদমে, তখন ঘুরে দাঁড়াতে বাড়ির ছোট বউ আর ছোট ছেলে দিল শাড়ির দোকান। ব্যবসার ক্যাপিটাল এল ভূত-পিসিমার গয়না বন্ধক রেখে। খাট-পালঙ্ক বাসনকোসন বেচে খেতে যাঁদের আপত্তি নেই, তাঁরা কিন্তু যথারীতি উঁচু নাক ঢের কুঁচকোলেন। বে-রোজগেরে কর্তামশাই খবর পেয়েই বললেন— ‘আমাগো বংশের পোলা দোকানদারি করতে বইছে? কুলাঙ্গার!’ পিরিয়ড পিস হোক বা হালফিলের কাহিনি— এই চারিত্র বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। ‘বং কানেকশন’। এই আধুনিক সময়েরই প্রেক্ষাপট। প্রবাসী অ্যান্ডি কলকাতা আসার পর তার ভাইদা (জেঠতুতো দাদা) তাকে নিজের বাবার কথা বলছে— ‘আমার বাপটা শালা সারা জিন্দেগি কেরানিগিরি করে চালিয়ে গেল, বললে আবার রেগে যায়!... (আমায়) ব্যবসা করতে দেবে না বলে তো শালা একটা পয়সা ধার দিল না। সেন বাড়ির ছেলেরা নাকি ব্যবসা করে না, করলে জাত যায়!’
কিন্তু বাঙালির ইতিহাস এই কথা বলে না। প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগে বাঙালি বংশপরম্পরায় বাণিজ্য করেছে। সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক, তাম্বুলবণিকদের একটা বড় অংশ বাংলার। ধনপতি সওদাগরের কাহিনি, চাঁদ সওদাগরের কাহিনি গড়ে উঠেছে এই মাটিতেই। পরবর্তী কালে দ্বারকানাথ ঠাকুর, মতিলাল শীল, নকুড় ধর, রামদুলাল দে সরকারের মতো লোকজনের মধ্যেও ব্যবসায়ী প্রবণতার ঘাটতি ছিল না। সে যুগেই মাড়ওয়ার থেকে এসে এ রাজ্যে ব্যবসা ফেঁদে কোটি-কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন জগৎ শেঠ। ব্যবসায়ী বলতে আজ যে মাড়ওয়ারি শ্রেণিকে দূর থেকে দেখে বাঙালি, তাকে ঠিকঠাক হিংসে করারও সে দম পায় না। তখন কিন্তু মাড়ওয়ারিদের সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছিল সে। তা হলে বাঙালি জাতি সেই টেনাসিটি ধরে রাখতে পারল না কেন? হয়তো বেহিসেবি ভোগবিলাসের জন্য, হয়তো দূরদর্শিতার অভাবে ভুল বিনিয়োগে, হয়তো সহজেই আত্মসন্তুষ্ট হয়ে ওঠার কারণে।
উনিশ শতকের সংবাদপত্রগুলি জগদ্দল বাঙালিকে তেড়ে গাল দিয়েও নড়াতে পারেনি। ‘সংবাদ প্রভাকর’ লিখছে, ‘তাঁহাদের ধনে বিদেশের লোক বড়মানুষ হইতেছে, রঙ্গে রত্নে অনঙ্গ দেশ ঐশ্বর্যশালী হইতেছে, বঙ্গমাতা এক্ষণে কেবল কতকগুলি মুটে ও চাকর প্রসব করিতেছেন।’ ‘সোমপ্রকাশ’ লিখছে, ‘প্রকৃতপক্ষে চাকুরীর এখন যেরূপ দুরবস্থা তাহার অপেক্ষা সামান্য মুদির দোকান করিয়া দিনাতিপাত করা ভাল। আমাদিগের সমাজে অলস অপদার্থ ও অশিক্ষিত লোকের সংখ্যা অধিক বলিয়াই এরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে, ...যাবৎ লোকের মন হইতে চাকুরী প্রবৃত্তি বিদূরীত হইয়া দেশের উন্নতির চেষ্টা ও স্বাধীন কার্যে প্রবৃত্তি না জন্মিবে তাবৎ প্রকৃত উন্নতির সম্ভাবনা নাই...।’
দশটা-পাঁচটার কেরানি-জীবনই বাঙালির অভীষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বটতলার ‘কেরানি-দর্পণ’ নাটকে দেখি, আপিসে ঢোকার মুখে এক ভিনরাজ্যের কুলি বলছে— ‘ক্যারে বাবু, ক্যা ফুটানি কর্তা তু, তোরা মাফিক্ বাবু হাম্ বাহুত্ দেখা হ্যায় দশ্ পনেরা রূপেয়া মে হাম দো তিনঠো করাণী রাখনে সেকতা...’! তবু এই ডালহৌসি স্কোয়ারই যেন বাঙালির একমাত্র লক্ষ্য। কালপেঁচা লিখেছিলেন এমনই এক ব্যাংক-কেরানি ভজহরিবাবুর কাহিনি। তহবিল তছরুপের অভিযোগে তাঁর চাকরি যায়। তবু রোজ বেলা দশটার মধ্যে নাকে-মুখে গুঁজে আপিস পৌঁছে যেতেন তিনি। দাঁড়িয়ে থাকতেন গেটের ঠিক বাইরে। যদি ওই দোতলা থেকে কোনও মতে বড়বাবুর দূরদৃষ্টি তাঁর ওপর পড়ে। ভজহরিবাবুর জীবনে দূরদৃষ্টি বলতে ছিল এই অসম্ভব কল্পনাটুকুই। কালপেঁচা লিখছেন, ‘কলকাতা শহরের লক্ষ লক্ষ নিরীহ নিরুপদ্রব কেরানীর মূর্তিমান প্রতিনিধি ভজহরিবাবু। জীবনের কোন আশা নেই, ভরসা নেই, কোন ইচ্ছা নেই, আকাঙ্ক্ষা নেই, কোন বিদ্বেষ নেই, অভিযোগ নেই।’ চাকরির জন্য, কেরানি-সত্তা টিকিয়ে রাখার জন্য যে স্ট্রাগ্ল যে কম্প্রোমাইজ বাঙালি করেছে, আজও করছে, তার ভগ্নাংশও যদি ব্যবসার জন্য করত, জাতটা অনেক উপরে উঠত। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লেখাতে তার আপত্তি নেই, ব্যবসার জন্য ব্যাঙ্কে লোনের অ্যাপ্লিকেশন করতে সে দু’বার ভাবে। প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরির পরীক্ষা থাকলে রেকর্ড ভিড় হয় ট্রেনে-বাসে। ব্যবসার জন্য ভিড় করতে হলে এই বাঙালির অধিকাংশই আস্তে আস্তে কেটে পড়ে আজও। ডালহৌসি স্কোয়ার বড় জোর শিফ্ট করে যায় সেক্টর ফাইভে। গড়ে ওঠে কর্পোরেট কেরানিকুল। রিসেশনের ভূত ইঞ্জিনিয়ারদের ঘাড়ে চেপে বসেছে, হাজার-হাজারের হাতে কোনও প্রোজেক্ট নেই, তবু ব্যবসা ফাঁদতে ভয়।
আসলে বাঙালি বিশ্বাসই করে ফেলছিল, শুধু ধর্মতলায় কর্মখালি নয়; মুশকিল আসানও উড়ে মালিই! নানা রাজ্যের লোক এ রাজ্যে এসে ব্যবসা করে টাকা কামিয়ে লাল হয়ে গেল। বাঙালি তাদের হ্যাটা করল, আর চাকরগিরি করেই কাটিয়ে দিল কয়েকশো বছর। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ‘বাঙালীর ধ্বংসের কারণ’ প্রবন্ধের শুরুতেই বলছেন— ‘আমরা যাহাদিগকে মেড়ো, ছাতুখোর ইত্যাদি আখ্যা দিয়া থাকি, তাহারাই সুদূর রাজপুতানার মরুপ্রান্ত হইতে রেলপথ হইবার পূর্বে পদব্রজে লোটাকম্বল সম্বল করিয়া, সত্যসত্যই ২/৪ পয়সার ছাতু খাইয়া, এই বাংলাদেশের বুকের উপর আসিয়া বসিয়াছে এবং শতবর্ষ ধরিয়া ক্রমান্বয়ে সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য আয়ত্ত করিয়াছে। তবুও আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে তাহাদের পারদর্শিতার কথা উপলব্ধি করিতে পারি না। আমরা দু’পাতা Shakespeare, Milton এর পদ আওড়াইয়া বা Differential Calculus এর পাতা উল্টাইয়া গর্বে স্ফীত হইয়া পড়ি, এবং মাড়োয়ারী প্রভৃতি অ-বাঙালী ভ্রাতাগণকে হীন ও মুরুব্বীয়ানার চক্ষে দেখি।’
ব্যবসা না করার এই যুক্তিকে খণ্ডন করতে দীর্ঘ দিনই বাঙালির কমন দুটি অজুহাত। প্রথমত, ব্যবসার টাকা সে পাবে কোথায়? হক কথা! তার পূর্বপুরুষ তো লকার-ভরা ধনসম্পদ রেখে যাননি। স্বল্প পুঁজির ব্যবসার রাস্তায় তো হাঁটতেই পারত মধ্যবিত্ত বাঙালি; কিন্তু সেখানে তার পাহাড়প্রমাণ ইগো। ‘বাঙালীর শক্তি ও তাহার অপচয়’ প্রবন্ধে প্রফুল্লচন্দ্র লিখছেন এই কথাই। ‘ছোট্ট ঘর ভাড়া লইয়া পশ্চিমা অশিক্ষিত লোক বিদ্যুতের যোগে গমপেষা কল চালায়। কলিকাতার অলিতে গলিতে এই প্রকার কত আছে। ইহারা মাসে ৭০/৭৫ টাকা উপার্জন করে। চতুর ও তীক্ষ্নবুদ্ধিবিশিষ্ট বাঙালীর সন্তান এই ব্যবসায় করে না। মূলধনের অভাবে নাকি বাঙালীর পক্ষে সম্ভব হয় না। অথচ এই প্রকার ব্যবসায়ে অতি সামান্য মূলধনের প্রয়োজন হয়।’ জাস্ট টাকার অঙ্কটা বদলে নিলে, এ সব কথা আজও ষোলো আনা প্রাসঙ্গিক মনে হয়। বাঙালির দ্বিতীয় অজুহাত— ব্যবসার চেষ্টা করেও বাই চান্স ধাক্কা খেলে, ব্যর্থ হলে, সে উঠে দাঁড়াবে কী করে? এ কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু বাঙালিই তো শুধু ব্যবসায় ফ্লপ করে না, সব দেশের মানুষই করে। তা হলে তারা পারে কী করে? কারণ তারা লেগে থাকতে পারে। লড়ে যেতে পারে। সেই কবে, ‘সোমপ্রকাশ’ পত্র লিখছে— ‘...বোম্বাইবাসীরা সেরূপ নহে। দুর্ভাগ্যক্রমে একবার ক্ষতিগ্রস্থ হইলেও বসিয়া না পড়িয়া কপাল ঠুকিয়া আবার দ্বিগুণ উৎসাহে কাহারও সাহায্য ভাগী হইয়া বাণিজ্য কার্যে রত হয় এবং অসাধারণ অধ্যবসায় বলে অল্প দিনেই ক্ষতি পূরণ করিয়া লয়।’ আর বাঙালি? সে এক বার পড়ে গেলে নিজের মায়ায় বুক ভাসিয়ে হাঁটুর ফুলোয় হাত বোলায় আর ডেকে ডেকে নাকে কেঁদে বলে, ‘এই হাঁটুটাঁ ছঁড়েঁ গেঁল বঁলেঁ, বুঁঝলেঁন, নঁইঁলেঁ...’!
এর পর নিজের অক্ষমতাটাকে সে একটা টুইস্ট দিল। নিজেকে বুঝিয়ে ছাড়ল, ব্যবসায়ী মানেই খারাপ লোক। এ দিকে, বাঙালি তো ভীষণ ভাল লোক। উঁচু ঘরের, খাঁটি চরিত্রের! গম্ভীর হয়ে সে রটাল, উচ্চবিত্ত মানেই অসৎ। তার প্রিয় খিস্তি হল— ‘বড়লোকের ব্যাটা!’ বড়লোক ব্যবসায়ীগুলো বোকা, মূর্খ, ভোঁদকা। ‘বিরিঞ্চিবাবা’-র কেসটাই ধরুন না, বাঙালিকে তিনি শোনাচ্ছেন বুদ্ধ, আইনস্টাইনের কাহিনি। যুক্তিবাদী বাঙালি তাঁর ঢপবাজি ধরেও ফেলছে। কিন্তু ১৯১৪-য় নিয়ে গিয়ে যাঁকে তিনি জলের দরে লোহা কিনিয়ে দিচ্ছেন, তিনি মেকিরাম আগরওয়ালা। বোকাসোকা অবাঙালি। ‘পরশ পাথর’ বানাতে গিয়ে স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ও টাইটেলের পরই পরদা জুড়ে লিখে দিচ্ছেন— ‘ইহাতে কোন ব্যক্তি বা সম্প্রদায়বিশেষের প্রতি সচেতন ভাবে কটাক্ষ হয় নাই’। কাদের কথা ভেবে এই বিধিসম্মত সতর্কীকরণ? কৃপানন্দ কাচালু? যে শেঠজি ছবিতে অ্যাপিয়ার করেই বলছেন— ‘বেটার নেভার দ্যান লেট’! বাঙালি দর্শক তাকে দেখে হেব্বি মজা পায়, কিন্তু ভুলে যায়, বাঙালি কেউকেটাদের নিজেদের বাড়িতে ডেকে বিনি পয়সায় দেদার মাল খাওয়ানোর ক্ষমতা রাখে এই শেঠজি। বাঙালি এই শক্তপোক্ত অর্থনৈতিক অবস্থাকে নম্বর দিতে চায় না। মনে করতে চায়, এই সব লোক লটের দরে হয় বোকা, নয় ধান্দাবাজ! নইলে বাঙালির নিজের ভিতই টলে যাবে। এত পড়াশোনা, এত ফুকো-দেরিদা করেও লক্ষ্মীর কৃপা থেকে বঞ্চিত থাকার জ্বালা এ ভাবেই জাস্টিফাই করে সে। নিজেকে দারুণ সৎ ও মহৎ হিসেবে দেখতে চায়। যেন গরিব থাকাটা অপরিসীম গৌরবের!
বাংলা মেনস্ট্রিম ছবিতেও দেখুন, নায়ক বা নায়িকার ভিলেন-টাইপ বাবা মানেই তাঁর বিরাট ব্যবসা, অগাধ সম্পত্তি। ধরুন, ‘দেয়া নেয়া’— উত্তমকুমার অভিনীত প্রশান্ত চরিত্রটির কাজকম্ম না-করে সর্ব ক্ষণ গান গাইতে চাওয়াকেই গ্লোরিফাই করে দেখানো হল। তাঁর বাবা বি কে রায় (কমল মিত্র) ব্যবসার ক্ষতি নিয়ে সরব হওয়ায় তাঁকে তুলে ধরা হল বেরসিক, রাগী, কিছুটা দুষ্টু লোক হিসেবেই। আবার ‘পথে হল দেরি’— মল্লিকার (সুচিত্রা সেন) বাবা বিরাট ধনী শ্রীপতি বন্দ্যোপাধ্যায় (ছবি বিশ্বাস) জয়ন্তর (উত্তমকুমার) ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘তোমরা কী, জমিদার না ব্যবসাদার?’ এই প্রশ্নটিই যেন বাঙালি দর্শকের কাছে মিস্টার বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরিচালকের খাটো করে দেখানোর হাতিয়ার! তা হলে কি বাংলা ছায়াছবিতে ব্যবসাকে পজিটিভ আলোয় দেখানোই হয়নি? বিলক্ষণ হয়েছে। হীরেন নাগের ‘সাবরমতী’। দুঃখের কথা একটাই, সে ছবিতে উত্তমকুমার অভিনীত প্রধান চরিত্রটির নাম— শঙ্কর সারাভাই। আর ছবির শুরুতেই পরদা জুড়ে ক্যাপশন— ‘শিল্পনগরী আমেদাবাদের পটভূমিকায় রচিত’! এমনি এমনি কি আর সানন্দে থাকে ন্যানো!
বাঙালি তাই নিজ বংশগৌরব ব্যাখ্যানে চির কালই ‘তাসের দেশ’-এর ছক্কার মতো সদাগরকে বলে এসেছে, সৃষ্টিকার্যে মগ্ন ব্রহ্মা বিকেলের দিকে প্রথম যে হাই তুললেন, সেই পবিত্র হাই থেকেই তার জন্ম! সাধে কি আর সে এত দিন সরকারি চেয়ার-টেবিলে ধুলোময় ফাইলের পাহাড়ের সামনে বসে মন্ত্রের মতো আওড়েছে— ‘হা-আ-আ-আই।/ হাতে কাজ নাই।/ দিন যায় দিন যায়।/ আয় আয় আয় আয়।/ হাতে কাজ নাই’?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.