বঙ্গের শিয়রে শমন, মাটি ধসছে পায়ের নীচেও
ত্তরাখণ্ডে শুধু পাহাড়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ভয়টা শুধু পাহাড় নিয়ে নয়। এ রাজ্যে তার দোসর সমুদ্রও। উত্তরে যেমন হিমালয়ের বিস্তীর্ণ ভূভাগ, তেমন দক্ষিণ জুড়ে দীর্ঘ উপকূল। এবং দুই প্রকৃতির মর্জির সামনে এ রাজ্য নেহাতই অসহায় বলে মনে করছেন বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ ও পরিবেশকর্মীদের বড় অংশ। যার জন্য তাঁরা মূলত দায়ী করছেন প্রশাসনিক গাফিলতিকে।
উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয়ের পরে অভিযোগ উঠেছে, পরিবেশবিদদের হুঁশিয়ারিতে কান না-দেওয়ারই মাসুল গুনতে হল ওই রাজ্যকে। পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন কেন্দ্রীয় আইন যথাযথ মানা হচ্ছে কি না, স্থানীয় প্রশাসন সে দিকেও নজর রাখেনি। প্রায় একই রকম ‘নির্লিপ্ততা’র জন্য আঙুল উঠছে পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম এমনকী ভুটানের প্রশাসনের দিকেও। আবহবিদেরা অনেকে বলছেন, বিশ্ব উষ্ণায়ন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দূষণে যে ভাবে আবহাওয়ায় দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে, তাতে দার্জিলিং-ভুটানের পাহাড়ে মেঘ-ভাঙা অতিবৃষ্টি কিংবা বঙ্গোপসাগরে অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় শুধু সময়ের অপেক্ষা। তেমনটা হলে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা কী হবে, তা ভেবে পরিবেশবিদ ও পরিবেশকর্মীরা যারপরনাই উদ্বিগ্ন।
যেমন উত্তরবঙ্গের পরিবেশ সংগঠন ‘ন্যাফ’-এর অনিমেষ বসু মনে করিয়ে দিচ্ছেন ১৯৯৩-এ ভুটানের অতিবৃষ্টি ও তার সঙ্গে আলিপুরদুয়ারের বিপর্যয়ের কথা। তিনি বলেন, “নদীর জল আচমকা ফুঁসে উঠে আলিপুরদুয়ার ভাসিয়ে দিয়েছিল। পাহাড় থেকে বয়ে আসা বড় বড় পাথর গুঁড়িয়ে দিয়েছিল বাড়ি-ঘর।” তাতেও কারও হুঁশ ফেরেনি। “সিকিমে পাহাড় গুঁড়িয়ে তিস্তার উপরে তিরিশটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে। ভুটানের পাহাড়ে দেদার ফাটছে ডিনামাইট। কেউ মাথাতেই রাখছে না যে, পুরো এলাকাটি
অতি ধস ও ভূকম্পপ্রবণ! প্রকৃতি বিরূপ হলে দোষটা কার?” প্রশ্ন তুলছেন অনিমেষবাবু।
একই ভাবে সুনামি ও আয়লা ঝড়ের ধ্বংসলীলা দেখেও প্রশাসন শিক্ষা নেয়নি বলে অভিযোগ। পরিবেশবিদেরা জানাচ্ছেন, দিঘা-মন্দারমণি-বকখালির বালিয়াড়ি ও ম্যানগ্রোভ অরণ্য ধ্বংস করে মাথা তোলা হোটেল-বাজারের সারি দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। এমনকী, কিছু হোটেল-বাড়িতে জোয়ারের জলও ঢুকে পড়ছে। ২০১১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার উপকূল নিয়ন্ত্রণ আইনকে জোরদার করলেও এখানে অবৈধ নির্মাণের জোয়ার ঠেকানো যায়নি।
ফলে ম্যানগ্রোভ ও বালিয়াড়ি প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে। অথচ সমুদ্রের রোষের সামনে জনপদের বর্ম বলতে এরাই। পরিবেশবিদেরা জানাচ্ছেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রাথমিক ধাক্কাটা ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের উপর দিয়ে যায়। চার বছর আগে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের দৌলতেই সরাসরি আয়লার প্রকোপ থেকে শহর কলকাতা রেহাই পেয়েছে। অন্য দিকে সাগরের কালান্তক ঢেউয়ের অভিঘাত প্রথম সহ্য করে বালিয়াড়ি রক্ষা করে পারিপার্শ্বিককে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র-বিজ্ঞানের অধ্যাপক আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “দিঘা-মন্দারমণি-বকখালিতে এই বালিয়াড়ি নষ্ট করে যথেচ্ছ হোটেল উঠেছে।
কোথাও তট-বিধি মানা হয়নি। কারও শাস্তিও হয়নি।”
আনন্দদেববাবু দীর্ঘ দিন দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের সভাপতির দায়িত্ব সামলেছেন। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এই উপাচার্যের স্বীকারোক্তি, অনিয়ম তিনি আটকাতে পারেননি। “মন্দারমণিতে তো খবর পেয়ে জেলাশাসক পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। রাজনৈতিক কর্মীদের বাধায় তাঁকে ফিরে আসতে হয়। তার পরে কোনও আমলা ঝুঁকি নেননি।” মন্তব্য আনন্দদেববাবুর। রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদার বলছেন, “বাম আমলে মন্দারমণির বালিয়াড়িতে হোটেল উঠেছে আইন ভেঙে। হাইকোর্টে মামলা চলছে। তার নিষ্পত্তির উপরে নির্ভর করছে হোটেলগুলোর ভবিষ্যৎ।”
উত্তরের পাহাড় ও দক্ষিণের উপকূলে বিপদ ঠিক কতটা গভীর?
জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল বিজন সাহা বলেন, “দার্জিলিং পাহাড় অতি ধসপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত। অতিবৃষ্টি হলে ওখানে উত্তরাখণ্ডের মতোই অবস্থা হবে।” বিজনবাবুর আক্ষেপ, “সতর্কতা না-মেনে গোটা তল্লাটে বাড়ি-ঘর উঠেছে। বার বার পাহাড়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। ধসের প্রবণতা বেড়েছে। একটা পাহাড়-ভাঙা জোরদার বৃষ্টিই সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। আমাদের স্রেফ বসে বসে দেখতে হবে।” একই ভাবে বিপর্যয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে উপকূল। বিজনবাবুর বক্তব্য: কেন্দ্রীয় সরকার তটবর্তী এলাকাকে পাঁচ অঞ্চলে ভাগ করেছে। ২০১১-র উপকূলরক্ষা আইন মোতাবেক প্রথম অঞ্চলে পড়ে মন্দারমণি, যেখানে বালিয়াড়ি নষ্ট করে নির্মাণ সম্পূর্ণ আইনবিরুদ্ধ। “কিন্তু আইন মানে কে?” প্রশ্ন এই ভূ-বিশেষজ্ঞের।
না-মানার মাসুল দিতে হচ্ছে কড়ায়-গন্ডায়। রাজ্য সেচ দফতরের রিপোর্ট বলছে, ‘প্রাকৃতিক ঘাত-প্রতিঘাত ও বালিয়াড়ির ঝাউবন কেটে জনপদ গড়ে ওঠায় একটু-একটু করে বসে যাচ্ছে দিঘা-শঙ্করপুর-উদয়পুর। উদয়পুর ও ওল্ড দিঘা থেকে মোহনা পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার এবং মোহনার পরে শঙ্করপুর-জলদা হয়ে মন্দারমণি পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার তটে ভাঙন দেখা দিয়েছে।’ পরিবেশবিদেরা বলছেন, সমুদ্রের জলের তাপমাত্রাবৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে জলস্তরবৃদ্ধির হার। ফলে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে জনপদ প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রতি মুহূর্তে।
বিশ্বব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক পরিবেশ-রিপোর্টেও এই আশঙ্কা প্রতিফলিত। যাদবপুরের সমুদ্র-বিজ্ঞানের অধ্যাপক গৌতমকুমার সেন বলছেন, “বালিয়াড়ি নষ্ট করে ফেলায় শঙ্করপুরে এখন দুর্বল নিম্নচাপেও বড় বড় ঢেউ! শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে কী হবে?” পরিবেশ-বিজ্ঞানী প্রণবেশ সান্যালের হুঁশিয়ারি, “বিশ্ব উষ্ণায়নের সঙ্গে বঙ্গোপসাগর-আরবসাগরে নিম্নচাপের শক্তি বাড়ছে। তাতে জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে। এখনই বঙ্গোপসাগর উপকূলে বালিয়াড়ি ও ম্যানগ্রোভের উপরে অত্যাচার বন্ধ করতে হবে।”
প্রকৃতি-পরিবেশের উপরে নির্বিচারে চাপ সৃষ্টির ফলে পাহাড়েও মেঘ-ভাঙা বৃষ্টির আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে বলে জানিয়েছেন প্রণবেশবাবু। ন্যাফের অনিমেষবাবু বলছেন, “পাহাড়কে যা নষ্ট করার, আমরা এত দিনে করেই ফেলেছি। এখন বিপর্যয়ের পূর্বাভাসই ভরসা। সেটা ঠিকঠাক পেলে অন্তত জীবনহানি কিছুটা কমানো যাবে।” রাজ্য সরকারের কী ভূমিকা?
পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শনবাবুর জবাব, “উপকূল বা পাহাড়ে যাতে নতুন করে বিধি ভেঙে নির্মাণ না-হয়, সে জন্য আমরা নির্দেশিকা জারি করেছি। নজরদারি চলছে। যেখানে নিয়ম ভাঙা হয়েছে, সেখানে কী করা যায়, তা-ও খতিয়ে দেখছি।” পাহাড়, অরণ্য, উপকূল ও জলাভূমি রক্ষায় তাঁরা কড়া আইনি ব্যবস্থা নিতে পিছপা হবেন না বলে আশ্বাস দিয়েছেন মন্ত্রী।
উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয় থেকে পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা নিল কি না, তা ভবিষ্যৎই বলবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.