শিক্ষার স্বাধীনতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা। সেটাই ছিল আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের (১৮৬৪-১৯২৪) লক্ষ্য।
গত কাল তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ শুরু হল। তাঁর শিক্ষা নীতি বিষয়ে লিখছেন
বিশ্বজিৎ রায় |
বাংলার বাঘ নামে ছোটবেলার ক্যুইজ বইগুলিতে তাঁর ছবি থাকত। গোঁফ দিয়ে চেনা যেত, সম্ভ্রমও জাগত। তবে ‘ক্যারিশমা’ যে দুই সমসাময়িকের থেকে তাঁর কিছু কম, অস্বীকার করার উপায় নেই। রবীন্দ্রনাথ ১৮৬১, বিবেকানন্দ ১৮৬৩, আশুতোষ ১৮৬৪। তবে, যে ভাবে প্রথম দুজনের সার্ধশতবর্ষে, ছবিতে নগর ভরানো যায়, আশুতোষ তত ছবিময় নন। ভুবনমোহন দ্যুতি নেই, কালাপানিও ডিঙোননি। কিন্তু কার্যকারিতায় আশুতোষও কম নন, কেবল ঘরানাটা আলাদা। বলা চলে, ঔপনিবেশিক বঙ্গদেশে পড়াশোনার বাইশ গজে তিনি কপিবুক ক্রিকেট খেলেছেন, কিন্তু জেদি কপিবুক ক্রিকেটারও কি চাইলে ম্যাচ উইনিং স্ট্রোক খেলতে পারেন না?
আশুতোষের ঘরানা শিক্ষা-ঘরানা মূলস্রোতকে মোটের ওপর স্বীকারই করে নেয়। প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুনকে বড় একটা চ্যালেঞ্জ না করে, খুব ভাল রপ্ত করে, নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যে থেকেই নিয়মতান্ত্রিকতার কাঠামোটিকে সংস্কার করতে চায়। ফলে নিয়ম ভাঙার ও বিকল্প নিয়ম গড়ার যে রোমান্টিক মাদকতা, তার স্বাদ-আহ্লাদ আশুতোষী ঘরানায় বড় একটা মেলে না। তবে নিয়ম মেনেই যে স্বাধীনতাস্পৃহা ও আত্মমর্যাদাবোধ বজায় রাখা যায়, আশুতোষ দেখিয়ে দিয়েছেন। এই ঘরানায় তাঁর প্রবেশাধিকার পারিবারিক সূত্রেই। |
তাঁর বাবা গঙ্গাপ্রসাদ কলকাতায় পড়াশোনা করতেই এসেছিলেন। পিতৃমাতৃহীন সতেরো বছরের দুর্গাপ্রসাদ ভাইদের হাল ধরলেন, কাজেই ইংরেজ আমলে পড়াশোনার যে নতুন ধারা চালু হয়েছিল সেটাই তাঁর খড়কুটো। ডাক্তার গঙ্গাপ্রসাদের প্রথম সন্তান আশুতোষ।
এই আশুতোষ ঠাকুরবাড়ির রবীন্দ্রনাথের মতো স্কুল পালানে নন, সিমলার দত্তবাড়ির নরেন্দ্রনাথের মতো ‘বোহেমিয়ান’ ছিলেন না। বাবার উৎসাহে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় অন্যতম সেরা ছাত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সে পড়াশোনার পদ্ধতি অনেকটাই বিদ্যাসাগরী কঠোরতার আদলে গড়া। রাত জেগে প্রদীপের আলোয় পড়াশোনা করতে গিয়ে শরীর খারাপই হয়ে গেল। অধিকাংশ সময়েই প্রথম, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ পাওয়া ভাল ছেলে। ১৮৭৫-এ কলকাতায় ‘থ্যাকার অ্যান্ড স্পিংক’-এর দোকানে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে ছাত্র আশুতোষের দেখা। বিদ্যাসাগর শিবনাথ শাস্ত্রীর সাউথ সুবার্বন স্কুলের ছাত্র আশুতোষকে ‘লাইফ অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার অব রবিনসন ক্রুসো’ কিনে দেন।
বিদ্যাসাগর যেমন সংস্কৃত কলেজে পরিবর্তন ঘটান, তেমনি আশুতোষও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার কার্যক্রম নানা ভাবে বদলে দেন। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে মাত্র চব্বিশেই তিনি সিন্ডিকেটের সদস্য, পরে দু’পর্যায়ে উপাচার্য। প্রথমে ১৯০৬-১৪, পরে ১৯২১-২৩। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ইতিহাস নিয়ে রীতিমত পড়াশোনা করেছিলেন। অধ্যাপক আইনজীবী মনট্রিও’র সংগ্রহে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাপর্ব থেকে তখন পর্যন্ত ক্যালেন্ডার, মিনিটস্ ছিল। তাঁর প্রয়াণের পর নিলামে আশুতোষ সে সব কিনে পড়লেন। ওই বছরেই আশুতোষের সঙ্গে স্যর রমেশচন্দ্র মিত্রের জমাট বিতর্ক হয়েছিল। রমেশচন্দ্র বলতেন বাঙালিরা এ বার স্বাধীন ভাবে উচ্চশিক্ষালয়গুলি চালাতে পারে, আর ছাত্র আশুতোষ সাহেবদের বাদ দিয়ে বিপ্লব চাননি। পরে সাহেব-পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা হয়েও এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নানা প্রদেশের মানুষের মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। তার জন্য সাহেবদের সঙ্গে বাক্যুদ্ধেও দ্বিধা করেননি।
১৯০৪-এ নতুন আইন অনুযায়ী ক্রমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ‘টিচিং ইউনিভার্সিটি’র মর্যাদা লাভ করে। ১৮৫৭-তে প্রতিষ্ঠালগ্নে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল নিতান্ত পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থা। দায়িত্ব নিয়ে আশুতোষকে স্নাতকোত্তর স্তরে পঠন-পাঠন কেন্দ্র রূপে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্রমে গড়ে তুলতে হচ্ছিল। সাহেব প্রশাসকেরা চেয়েছিলেন তদানীন্তন ভারতের সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একই রকম প্রশাসনিকতায় আটকে ফেলতে। আশুতোষ এর ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। ২১ মার্চ ১৯০৪। আশুতোষ পরিষ্কার বলে দিলেন, “In the prosecution of its academic aims, the university should be free from all external censorship of doctrine |
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক |