|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
সংরক্ষণের স্থায়ী উপায় ভালবাসা |
জয়া মিত্র |
মায়কল পাহাড়ের শার্দুলীরা, সুভদ্রা ঊর্মিলা মজুমদার। পূর্বালোক
(প্রাপ্তিস্থান: এই অবকাশে, ১৮/৭ ডোভার লেন, কল-২৯), ২৫০.০০ |
মানুষ বড়ই আজব জীব, ভাবল গুলু। খুব বোধবুদ্ধি আছে বলে তো মনে হয় না। ওরা যদি সত্যিই বনের প্রাণী দেখতে আসে তা হলে এত গোলমাল করে কেন! ওরা বোঝে না, চেঁচামিচি করলে জীবজন্তু বিরক্ত হয়ে অন্য দিকে চলে যায়?’ ঠিক এ রকম ভাষায় ভাবে না জীবজন্তুরা, কিন্তু মানুষ যখন বনের প্রাণীদের কথা ভাবাতে চাইবে অন্য মানুষদের, তখন নিজের ভাবনা আর ভাষা-ই ব্যবহার করতে হবে তাকে। মায়কল পাহাড়ের শার্দুলীরা আসলে তো মানুষেরই শোনার গল্প, বনের পশুপাখিদের দিক থেকে বলা। মধ্যপ্রদেশে এখনও বেঁচে থাকা কিছু ঘন জঙ্গলের অন্যতম অঞ্চল মায়কল পর্বত শৃঙ্খলা। সেই প্রাচীন অরণ্যপ্রকৃতি চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রাচীন এই বনের গাছপালা ও ছোট থেকে বড় প্রাণীদের পরস্পরের সঙ্গে জড়ানো জীবন, সেই ছন্দোবদ্ধ বিপুল জীবনের মধ্যে নিত্য ঢুকে পড়া মানুষের তৈরি হিংস্রতার ত্রাস এই নিয়ে লিখেছেন সুভদ্রা ঊর্মিলা মজুমদার। বনের অসাধারণ বর্ণময় জীবনশৃঙ্খলা ছিঁড়ে যাচ্ছে অল্প কিছু মানুষের অবিমৃষ্যকারী যুক্তিবিহীন লোভে— এই জরুরি এবং বহু আলোচিত বিষয়টি লিখতে গিয়ে প্রায় একশো ষাট পৃষ্ঠা ধরে সমস্যার দিক থেকে কথা বলেননি লেখক, জঙ্গলের মধ্যে কে জানে কত বছর ধরে পড়ে থাকা শুকনো পাতার মতো নরম ও রূপময় ভাষায় লিখেছেন সৌন্দর্যের কথা, ভালবাসার কথা, বেদনার কথা, নানান জরুরি কথার সুতো বুনেছেন গল্পে— প্রাকৃতিক প্রাণ-শৃঙ্খলার মধ্যে কোথায় বাঘের স্থান, তৃণবহুল জঙ্গলে বাঘদের বেঁচে থাকা কেন এমন জরুরি, কী কী কারণে বাঘ বিরল হয়ে যাচ্ছে একদা বাঘ-রাজ্য মধ্যপ্রদেশের টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া অরণ্যে, অরণ্যপ্রাণের সঙ্গে কেমন অঙ্গাঙ্গী বাইগাজাতির মতো বনবাসী মানুষদের অস্তিত্ব, পরস্পরের সঙ্গে কত সূক্ষ্ম ও জটিল নিয়মে বাঁধা ছোট ও বড় পশুপাখি, গাছ-লতা-ফুলের জীবন এই প্রতিটি বিষয়ই উপন্যাসে এসেছে। কিন্তু কোনও ‘পরিবেশ পাঠ’-এর নীরস কেজো বিবরণে নয়, সৃজনশীল মানসের নিজস্ব বেদনাবোধে। প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁজখবরের কাজে বার বার ওই অঞ্চলে গিয়েছেন সুভদ্রা ঊর্মিলা। দেখেছেন ওই সমৃদ্ধ বনভূমির আসন্ন বিপদ। সংরক্ষণের একমাত্র স্থায়ী উপায় ভালবাসা। সেই ভালবাসা থেকেই অরণ্য-জীবনের অশেষ সৌন্দর্য আর শৃঙ্খলা-রহস্যকে ভারি মমতায়, কুশলতায় খুলে-মেলে দেখাচ্ছেন তিনি। ‘ভোর না হতেই জলা ডোবা পুকুর বিল থেকে কুয়াশা ওঠে সরু সুতোর মত, মাকড়সার জালের মত।... কুয়াশা বনের মেঝের ওপর ভেসে বেড়ায়, ঝোপেঝাড়ে পড়ে থাকে, বড় বড় গাছ থেকে... কম্বলের মত ঝোলে।’ এই জঙ্গলের গ্রীষ্ম-বর্ষা, মা হারিয়ে ফেলা শিশু বাঘ, বাঁদর, বনবিভাগের হস্তিনী, সজারু, বেজি, দুষ্টু মানুষের ভয়ে নিজের জঙ্গল ছেড়ে যেতে বাধ্য বিষণ্ণ প্রকাণ্ড বাঘ এদের দিক থেকেই বলা হচ্ছে সমস্ত উপাখ্যানটি।
বহু-চর্চিত ‘জাঙ্গল বুক’-এ মোগলি ও বন্য জন্তুদের চিত্রণে যথেষ্ট স্পষ্ট ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির চিহ্ন। সেই বইয়ের চেয়ে অনেক বেশি করে মনকে স্পর্শ করে গভীর বিশাল সৌন্দর্য ও তাকে হারানোর আসন্ন বেদনাময় মায়কল পাহাড়ের এই উপাখ্যান। জঙ্গল ও জঙ্গলবাসী মানুষ-সহ প্রাণীদের বিপন্নতা। তাদের জল কমে যাওয়া, খাবার কমে যাওয়া, আড়াল কমে যাওয়া। অল্প কিছু ক্ষমতাধারী মানুষের নিষ্ঠুর লোভের মুখে বনের সর্বক্ষণের বিপন্নতা। এই বেদনাবোধটিই কেবল শিশু-কিশোরদের হাতে তুলে দেওয়ার জিনিস। বাকি যা কিছু, রক্ষা করার ভাবনা, চেষ্টা তারা নিজেরাই করবে ভালবাসলে।
দৃষ্টিভঙ্গির অন্য একটি প্রকাশও চমৎকৃত করে। ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে জরুরি সব ভূমিকা বেজি-বউ তুকতুকি থেকে বিশাল হস্তিনী ঝুমরির মতো অনেক স্ত্রীজাতীয়ের হওয়াই নয় শুধু, শার্দুলী আর তার ছেলেমেয়েদের মূল আখ্যানটি চলছে মায়ের দিক ধরে, মাতা-কন্যা অনুক্রমে। পুরুষজাতীয়েরা আছে, স্নেহ-বন্ধুত্ব-সম্ভ্রম সম্পর্কেই আছে। স্নেহ ও সংরক্ষণের ভাবনা থেকে এই যে উপস্থাপনা, এই হয়তো মেয়েদের দিক থেকে দেখা বা মানবীচেতনা। সমগ্র লেখাটির মধ্যে ছড়িয়ে থাকা সৌন্দর্য ও বেদনার যে আলো, মেয়েদের দিক থেকে দেখা, ক্ষমতার উল্টো দিক থেকে এই দেখাই বুঝি সেই আলোর উৎস। এই ভিন্ন দেখা থেকেই সেই গভীরতা অর্জন করে এ বই, যা ‘ছোটদের’ আর ‘বড়দের’ গণ্ডি মুছে ফেলে।
আকারে, সৌকর্যে, গল্প বলার ধরনে মনোজ্ঞ বইটির সঙ্গে ভারি সুন্দর সুর বেঁধেছে কৃষ্ণেন্দু চাকীর ছবি। |
|
|
|
|
|