জানি কোনও তুলনাই হয় না, তবু এ বারের কনফেডারেশন কাপের দীর্ঘতম ম্যাচ নিয়ে লিখতে বসে মনে পড়ে যাচ্ছে আটের দশকের শেষ দিকে একটা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের কথা।
সে বার বড় ম্যাচের আগে আমরা ভাল জায়গায় ছিলাম না। ম্যাচের আগে সল্টলেক স্টেডিয়ামের ড্রেসিংরুমে টিমমেটদের তাতাতে গিয়ে বলেছিলাম, “ওরা যত ভালই খেলুক না কেন, শুরু থেকে কাউন্টার অ্যাটাকে ঝটকা দিলে আমরাই খেলাটা নিয়ন্ত্রণ করব।” মাঠেও সেই কাউন্টার অ্যাটাক থেকেই ম্যাচটা ২-০ বার করে নিয়েছিল মোহনবাগান।
বৃহস্পতিবার রাতে কনফেড কাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে শুরু থেকে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের ডিফেন্সকেও কাউন্টার অ্যাটাকেই পেড়ে ফেলেছিল পির্লো, মাজ্জোরা। কিন্তু সব খেলার মতো ফুটবলেও ‘লাক ফ্যাক্টর’ বলে একটা কথা আছে। বৃহস্পতিবার সেটা কথা বলেনি ইতালির হয়ে। একশো কুড়ি মিনিটের পর টাইব্রেকারেও নয়, সাডেনডেথে জিতে দেল বস্কির স্পেন ফাইনালে গেলেও এখনই ভবিষ্যদ্বাণী করে রাখছি, এক বছর পরের বিশ্বকাপে এই ইতালি কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বীদের রাতের ঘুম কেড়ে নেবে।
গ্রুপ লিগে তিন ম্যাচে ১৫ গোল দিয়ে মাত্র এক গোল হজম করেছিল স্পেন। সেখানে ইতালি ৮ গোল করার পাশাপাশি ৮ গোল খাওয়ায় অনেক বিশেষজ্ঞ ইতালিকে সেমিফাইনালে পিছিয়ে রেখেছিলেন। মাফ করবেন, আমি সেই দলে ছিলাম না। জানতাম প্রান্দেলির ইতালি আসল ম্যাচে একটা জোরদার লড়াই দেবেই। মনে রাখবেন, ইনিয়েস্তাদের ওই ১৫ গোলের মধ্যে কিন্তু তাহিতিকে দেওয়া ১০ গোল রয়েছে। আর ইতালির খাওয়া আট গোলের মধ্যে অনেকগুলো গোল অফসাইড কিংবা রেফারির অন্য ভুল সিদ্ধান্ত নয়তো হাফচান্স থেকে। সুতরাং কাতানেচিওর জনক দেশ যে তিকিতাকা দেখে ভড়কে যাবে না তা জানতাম। এটাও জানতাম, এক বছর আগে ইউরো ফাইনালে স্পেনের কাছে ০-৪ হারের শিক্ষাও কাজে লাগাবে ইতালির মতো মহান ফুটবল ইতিহাসের দেশ। |
মাঠ ছাড়ছেন হতাশ বুফোঁ। |
জয়ের পেনাল্টি মেরে নাভাস। |
|
মাঠেও ঠিক তাই হল। ধুরন্ধর ফুটবল-মস্তিষ্ক সিজার প্রান্দেলি বুঝেছিলেন, স্পেনের তিকিতাকা রুখতে দুটো জিনিস দরকার।
এক) মাঝমাঠে জাভি-ইনিয়েস্তা ব্রিগেডের পা থেকে বল কেড়ে কাউন্টার অ্যাটাকে গিয়ে দরকারে সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ডিফেন্সে নামতে হবে একই রকম তীব্র গতিতে। নিজের টিমের আট জন উঠলে যেন নামেও আট জন।
দুই) স্পেনের দুই সাইডব্যাক ইয়র্দি আলবা ও আর্বেলোয়ার ট্যাকলের সময়জ্ঞানের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে দুই উইং দিয়ে মাজ্জো ও জিয়াচেরিনিকে ঝড় তুলতে হবে।
৩-৪-২-১ ছকে কাউন্টার অ্যাটাক নির্ভর আলট্রা ডিফেন্সিভ ফুটবল খেলতে নেমে এই দুটোর সঙ্গে আরও দুটো জিনিস করছিল প্রান্দেলির ছেলেরা। ট্রায়াঙ্গুলার কভারিং এবং থার্ড ম্যান মুভ। এতে স্পেনের তিকিতাকা কোণঠাসা হয়ে থাকল মিডল থার্ডেই। কমে গেল ওদের সেই অবিশ্বাস্য গতি। ইতালির ভাগ্য খারাপ। চোট পেয়ে বালোতেলি টুর্নামেন্টের বাইরে না চলে গেলে ম্যাচটা টাইব্রেকারেই যায় না।
ইতালির জমাট রক্ষণের পাশাপাশি একই রকম জমাট আক্রমণের থিওরির সামনে প্রথম আধঘণ্টাতেই দেখলাম অভিজ্ঞ দেল বস্কি-ও অন্য চাল দিলেন। বুঝেছিলেন ইতালীয়রা মাঝমাঠেই বোতলবন্দি করে ফেলেছে স্পেনের পাসের ঢেউকে। তাই যেটা এ বার ব্রাজিলে তাঁর দলের নেগেটিভ ফ্যাক্টর, সেই গরম এবং আর্দ্রতাকেই ঢাল করলেন বিশ্ব আর ইউরো জয়ী স্পেন কোচ। অপেক্ষা করছিলেন পরের দিকে কখন চিয়ালিনি-বনুচ্চিরা ক্লান্ত হবেন। সেটা হতেই মরণ কামড় মাতা, নাভাসদের। তা সত্ত্বেও ইতালির শেষ ডিফেন্স বুঁফোকে ভাঙা সম্ভব হয়নি। কেবল টাইব্রেকারে ১৩তম শটের সময়ই মনঃসংযোগে ভুল হয়ে গিয়েছিল ইতালির কিকার বনুচ্চির। পরের স্পট কিকে শান্ত মাথায় ম্যাঞ্চেস্টার সিটি-র স্প্যানিশ তরুণ নাভাস গোল করে স্পেনকে ফাইনালে তুলে বুঝিয়ে দিল, কেন গত ছ’বছর বিশ্ব ফুটবল রাজ করছে লাল জার্সি। চ্যাম্পিয়নই পারে অনন্ত চাপ সামলাতে। |
গ্যালারিতে উচ্ছ্বল পিকের বান্ধবী শাকিরা। |
এখন প্রশ্ন, ইতালিকে হারাতে স্পেনকে যদি তাদের সাধের তিকিতাকা দূরে সরিয়ে কৌশলের ফুটবল খেলতে হয় তা হলে ফাইনালে দুরন্ত ফর্মে থাকা নেইমারদের ব্রাজিলের বিরুদ্ধে কী হবে? তবে টুর্নামেন্টের দুই সেরা দলের ফাইনালে রবিবার যদি প্রথমার্ধটা জাভিরা ইতালি ম্যাচের মতো খেলে, তা হলে মারাকানাতে ভুগতে হতে পারে স্পেনকে। কারণ কনফেডে নেইমারের পাশাপাশি ব্রাজিলের এক্স ফ্যাক্টর তাদের দুই বিশ্বজয়ী কোচ স্কোলারি-পাহিরা জুটিও। ব্রাজিলকে তাদের নিজের দেশে সামলাতে গেলে আমার মতে ইনিয়েস্তা আর দাভিদ সিলভার মাঝে ফাব্রেগাসকে নামিয়ে ডেভিড লুইজদের পলকা রক্ষণকে ফের ‘ফলস নাইন’-এর ভূত দেখানোই বোধহয় ভাল দেল বস্কির। উদ্দেশ্য, লুইজ গুস্তাভো আর পউলিনহোদের মনঃসংযোগ নষ্ট করা। সঙ্গে জাভি-ইনিয়েস্তা পুরো ফিট আর নিজেদের ফর্মে থাকলে স্প্যানিশ পাসিং মাস্টারদের সামনে স্কোলারির চিন্তা বাড়বে বই কমবে না।
|