পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের কি কলেজে ভর্তি হওয়া ঝুঁকির কাজ হইয়া পড়িতেছে? বিশেষত পদার্থবিদ্যা, রসায়ন কিংবা জীবনবিজ্ঞানের মতো বিষয়ে? যে-সব কলেজে বিজ্ঞানের প্র্যাকটিকাল ক্লাস বিকালের দিকে হয় এবং ছাত্রীদের বাড়ি ফিরিতে সন্ধ্যা হইয়া যায়, তেমন কলেজে কি সেটাই দস্তুর হইয়া পড়িবে? সম্প্রতি রাজারহাটের ডিরোজিও মেমোরিয়াল কলেজের অভিজ্ঞতা তেমন আশঙ্কার কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এই কলেজেরই এক পড়ুয়া কামদুনি গ্রামের ছাত্রী সম্প্রতি বাড়ি ফিরিবার পথে নৃশংসভাবে ধর্ষিতা ও নিহত হইয়াছেন। অতঃপর কলেজে ভর্তি হওয়ার মরসুমে দেখা যাইতেছে, কোনও ছাত্রীই আর সেখানে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হইতে চাহে নাই, সকলেই কলা বা মানবীবিদ্যার বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তি হইয়াছে। মেয়েদের বিজ্ঞান পড়িবার প্রবণতা এখনও কম। তাহার অনেক কারণ আছে। কিন্তু নিরাপত্তাবোধের অভাব সেই প্রবণতাকে আরও জোরদার করিতেছে, এমন পরিস্থিতিকে দুর্ভাগ্যজনক বলিলে কম বলা হয়। এবং, কামদুনির ঘটনা ও ডিরোজিও কলেজের অভিজ্ঞতা, দুইয়ের কার্যকারণসম্পর্ক অস্বীকার করা কঠিন। এ ধরনের একটি ঘটনাই যে একটি সমগ্র অঞ্চলের বহু গ্রামে স্ত্রী-শিক্ষার সম্ভাবনাতেই অন্তর্ঘাত করিতে পারে, তাহার সংকেতও স্পষ্ট। এবং, কামদুনির ঘটনাটি কোনও ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা নয়। সামগ্রিক ভাবেই পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের নিরাপত্তার অভাববোধ প্রবল, জাতীয় পরিসংখ্যানেও তাহার সুস্পষ্ট প্রতিফলন।
স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীদের আসা-যাওয়ার পথে ধর্ষিত বা শ্লীলতাহানি হওয়া কিংবা আক্রান্ত, নিহত হওয়ার একের পর এক ঘটনাগুলির বৃহত্তর সামাজিক কুফল ইহাই। গ্রামাঞ্চলে, বিশেষত দুর্গম, প্রত্যন্ত অঞ্চলে, গঞ্জে-মফস্সলে, যানবাহনহীন, নির্জন, অনালোকিত রাস্তায় রাজনৈতিক দল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের নিরবচ্ছিন্ন নারীনিগ্রহ রাজ্যের মেয়েদের একটি বড় অংশকে লেখাপড়া শিখিবার জন্য ঘরের বাহিরে যাইতেই নিরুত্সাহিত করিতে পারে, এমন আশঙ্কা গুরুতর। অভিভাবকরা যখন দেখিতেছেন, তাঁহাদের কন্যাসন্তানদের রাস্তাঘাটে কোনও নিরাপত্তা নাই, দুঃশাসনদের দমন করার বা ভয় পাওয়াইবার মতো কোনও প্রশাসন নাই, উপরন্তু নিগৃহীতদেরই ভীতিপ্রদর্শনের, সন্ত্রস্ত করার নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা আছে, নিগ্রহের প্রতিবাদ করিলে বা প্রতিকার চাহিলে গ্রামবাসীদের রাষ্ট্রদ্রোহে অভিযুক্ত করার স্বৈরাচার আছে, তখন কাহার বা কীসের ভরসায় তাঁহারা মেয়েদের পড়িতে পাঠাইবেন? এমনিতেই এখনও বঙ্গীয় সমাজে মেয়েদের ঘরকন্না শিখাইবার বদলে লেখাপড়া শিখাইবার বিরুদ্ধে অন্তঃসলিলা আপত্তির ফল্গুধারা প্রবহমান। সেই সমাজ বা সম্প্রদায়ের মেয়েরা তো বিদ্যার্জনে বাড়ির বাহির হইতে অতঃপর আরও শঙ্কিত বোধ করিবে।
রাজ্যের অনেক কলেজেই পড়ুয়াদের দূর-দূরান্ত হইতেই পড়িতে আসিতে হয়। মেয়ে পড়ুয়াদের অধিকাংশেরই নিরাপত্তার সমস্যা পারিবারিকভাবে মিটাইতে অভিভাবকরা (দাদা-বাবা-কাকা-ভাই) অন্তত বাড়ি ফেরার সময় মাঝপথ অবধি আগাইয়া আসেন। এক দিন আসিতে ভুল বা বিলম্ব হইলে রাজ্যময় দাপাইয়া বেড়ানো দ্বিপদ প্রাণিকুল কী করে, প্রতিদিনই তাহার নমুনা মিলিতেছে। প্রশাসন যদি রাজ্যের মেয়েদের উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী হয়, তবে প্রথমেই ছাত্রীদের যাতায়াতের সুবন্দোবস্ত করিতে নিয়মিত পরিবহণের ব্যবস্থা করিতে পারে। দ্বিতীয়ত স্কুলের উঁচু ক্লাস কিংবা কলেজের মেয়ে পড়ুয়াদের জন্য ছাত্রী-নিবাস গড়া যাইতে পারে, যাহাতে যাতায়াতের ঝক্কি, ঝুঁকি ও নিরাপত্তাহীনতা দূর হয়। তবে মহিলাদের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ঘোষণায় যে চমক আছে, ছাত্রী-নিবাস তৈয়ারিতে তাহা নাই। তা ছাড়া, মেয়েদের নিরাপদ কলেজ-যাত্রা লইয়া রাজ্যের শাসকদের মাথাব্যথার প্রমাণও পাওয়া যায় নাই। ডিরোজিও কলেজের অধ্যক্ষ আশপাশের গ্রাম হইতে পড়িতে আসা মেয়েদের পথ-নিরাপত্তার জন্য পরিবহণ মন্ত্রীকে বাস-পরিষেবা চালু করার যে-প্রস্তাব পাঠাইয়াছেন, মন্ত্রী-মহোদয় এখনও তাহার জবাব দেন নাই। হয়তো ভাবিতেছেন, মেয়েদের নির্জন পথ দিয়া একা বাড়ি ফিরিবার কী দরকার! |