|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
ধীর গতিতে পরিবর্তিত হয় প্রকৃতির নির্যাস |
আকার প্রকারে অনুষ্ঠিত হল গণেশ হালুই-এর একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ |
আমাদের দেশের ১৯৬০-এর দশক পরবর্তী চিত্রকলার ধারায় গণেশ হালুই-এর প্রধান অবদান এই যে বাংলার নিসর্গের সারাৎসারকে রূপান্তরিত করে তিনি বিমূর্ততার এক বিশেষ অভিজ্ঞান তৈরি করেছেন। বিমূর্তের ভিতর দিয়ে ঐতিহ্য ও আধুনিকতা, স্বদেশ ও বিশ্বকে সমীকৃত করেছেন। এক সময় তিনি ছিলেন মূলত নিসর্গের শিল্পী। সেই নিসর্গের ভিতর প্রকৃতির যে নির্যাস, তা খুব ধীর গতিতে পরিবর্তিত হয়েছে। দৃশ্যের বিশদ বা অনুপুঙ্খ বর্ণনা কমে এসেছে। জেগে থেকেছে রেখা ও ছায়াতপে গড়া সুস্মিত এক ছন্দ। সেই ছন্দের ভিতর দিয়েই তিনি শুধু প্রকৃতির নয়, জীবনের অন্তর্লীন আনন্দের সুরটিকে উন্মীলিত করেছেন।
এ রকম উন্মীলনেরই সমৃদ্ধ কিছু রূপায়ণ দেখা গেল সম্প্রতি আকার প্রকার গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত তাঁর প্রদর্শনীতে।
প্রকৃতির অন্তর্লীন জ্যামিতিক সারল্য নিয়ে খেলতে খেলতে তিনি তৈরি করেছেন নিসর্গের অনৈসর্গিক ছন্দ। এগুলো অনেকটা তাঁর আত্মকথনের মতো। যেন একান্ত সঙ্গোপনে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছেন নৈঃশব্দ্যের ভাষায়। কেবলমাত্র রেখা ও ছায়াতপের বিভিন্ন বিভঙ্গে ও বিস্তারে। এই চিত্রমালার অধিকাংশ ছবিই তিনি এঁকেছেন ২০১২ সালে। কিছু ছবি ছিল ২০০৯ থেকে ২০১১-র মধ্যে আঁকা। আর অল্প কয়েকটি, গোটা চারেক ছবি ২০০৪ ও ২০০৫ সালের। অস্বচ্ছ জলরং বা গুয়াশ মাধ্যমের এই কয়েকটি ছবিতে আমরা পাই তাঁর পরিণত পর্বের নিসর্গের বিমূর্তায়নের অনুধ্যান। এই ছবিক’টিকে প্রেক্ষাপটে রেখে আমরা যদি তাঁর রেখাধৃত অনৈসর্গিক ছন্দের সামগ্রিক চিত্রমালার দিকে তাকাই, তা হলে তাঁর বিবর্তনের রূপরেখার কিছু আভাস অনুধাবন করতে পারি। বোঝার চেষ্টা করতে পারি প্রকৃতির দৃশ্যমান স্বরূপকে রূপান্তরিত করে কেমন করে শিল্পী তার অনৈসর্গিক ছন্দটিকে জাগিয়ে তুলেছেন। নিসর্গকে সঙ্গীতময় এক অনৈসর্গিক ছন্দে উদ্ভাসিত করেছেন। রেখায় রূপবদ্ধ করেছেন বিভিন্ন জ্যামিতিক আকার। কখনও বা শুধু রেখাই নানা বিভঙ্গে সঞ্চরমাণ হয়েছে। হাল্কা টোন বা ছায়াতপও ব্যবহার করেছেন। |
|
শিল্পী: গণেশ হালুই |
১৯৫৬-তে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পাশ করেন। ১৯৫৭-তে চাকরি নিয়ে চলে যান অজন্তায়। অজন্তার ছবির প্রতিলিপি তৈরির কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অজন্তার ছবির নান্দনিকতা ও তার প্রেক্ষাপটের বৌদ্ধ দর্শন তাঁর নিজের ছবির বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। ১৯৬২-তে কলকাতার আর্টিস্ট্রি হাউসে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। অজন্তার অনুকৃতি কিছু দেখিয়েছিলেন এই প্রদর্শনীতে। ১৯৭০-এ এঁকেছিলেন ‘সুবর্ণরেখা’ চিত্রমালা। গ্রামীণ ভারতবর্ষের করুণ বাস্তব বলিষ্ঠ ও স্পষ্ট ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল সেখানে। ১৯৭১-এ তিনি কলকাতার ‘সোসাইটি অব কন্টেম্পোরারি আর্টিস্টস’ দলের সদস্য হন। সেই সময় থেকেই নিসর্গ রচনায় তাঁর খ্যাতি সারা দেশে পরিব্যাপ্ত হয়।
১৯৮৭-র নভেম্বরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘মেটাস্কেপ’ শিরোনামে তাঁর একক প্রদর্শনী। গুয়াশ মাধ্যমে সেখানে এঁকেছিলেন সজল ও শ্যামল প্রায় নির্জন এক ভূখণ্ডের নিসর্গ। ১৯৮৯-এর প্রদর্শনীতে শিল্পীর প্রকাশভঙ্গি আরও রূপান্তরিত হল। মাঠ, নদী, আকাশ, গাছ, পথঘাট ইত্যাদি মিলিয়ে নিসর্গের সমস্ত আভাসই রয়েছে। কিন্তু তাদের বিস্তৃত কোনও বর্ণনা নেই। নিসর্গের সারাৎসারকে আত্মস্থ করে তা হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র অনুষঙ্গের বিমূর্ত রচনা। নিসর্গ-ভিত্তিক এই বিমূর্ততাই ক্রমে ক্রমে তাঁর ছবিতে রূপান্তরিত ও পরিশীলিত হয়েছে। ১৯৯২তে ‘কনফ্লিক্ট’ শিরোনামে তাঁর একটি প্রদর্শনী হয়। স্থাপত্যের সংঘাতময় জ্যামিতি প্রাধান্য পায় সেখানে। ১৯৯৩-এর প্রদর্শনীতে বিমূর্ততা আরও প্রগাঢ় হয়েছে। ২০০৬-এ বেনারসের নিসর্গ নিয়ে প্রদর্শনী করেন। সেখানকার স্থাপত্য বিমূর্তায়িত হয় সেখানকার আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলের অনুষঙ্গে। ২০০৭-এর নভেম্বর-ডিসেম্বরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল ‘আনওয়ান্টেড’। তাঁর মতে ‘যা কাম্য নয় তা ছবির বিষয় নয়’। এই প্রদর্শনীতেই শিল্পীর একটি ভাবনা ছিল, বাস্তবের সীমাবদ্ধতাকে সীমাহীনতার দিকে নিয়ে যাওয়ার। এই প্রত্যয়ই আরও পরিশীলিত ও রূপান্তরিত হয়ে এ বারের প্রদর্শনীর অন্তর্গত চিত্রমালায় পৌঁছেছে। নিসর্গ রূপান্তরিত হয়েছে অনৈসর্গিক জ্যামিতিক ছন্দে। |
|
|
|
|
|