হাড়-জিরজিরে চেহারা আর গোবেচারা মুখের যুবককে দেখলে কে বলবে, তিনিই ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে একদা গড়ে ওঠা মাওবাদীদের একমাত্র ‘প্ল্যাটুন’-এর কমান্ডার!
করণ হেমব্রমকে পাওয়া গেল লালগড়ের কাঁটাপাহাড়ি এলাকার ছোটপেলিয়া গ্রামে তাঁর বাড়িতেই। সেই ছোটপেলিয়া, যেখানে আদিবাসী মহিলাদের উপরে পুলিশি অত্যাচারকে লালগড় আন্দোলনের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়। ২০০৮-এর নভেম্বরে শালবনি-ফেরতা তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয় তাক করে মাওবাদীদের ঘটানো ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণের পরে, ওই আদিবাসী-প্রভাবিত প্রত্যন্ত গ্রামে পুলিশ ও সিআরপি ঢুকেছিল মূলত করণ হেমব্রমের খোঁজেই। পায়নি। অনেক পরে, ২০১০-এর জানুয়ারিতে করণকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এখন তিনি জামিনে মুক্ত।
|
করণ হেমব্রম।
—নিজস্ব চিত্র |
নিজের জরাজীর্ণ কুটিরে দাঁড়িয়ে করণ যদিও দাবি করেন, “আমার সঙ্গে ওই বিস্ফোরণের কোনও সম্পর্ক নেই। এমনকী, লালগড়ের প্ল্যাটুন কমান্ডার হওয়া সত্ত্বেও আমি জানতাম না, ওই বিস্ফোরণ পার্টির কারা করেছিল। আজও জানি না। কিষেণজি চেপে গিয়েছিলেন।” প্রাক্তন এই মাওবাদী নেতার কথায়, “আমি যে সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছিলাম, সেটা অস্বীকার করছি না। গোটা রাজ্যে একমাত্র লালগড়েই আমার নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল প্ল্যাটুন, বাকি সব জায়গায় ছিল শুধু স্কোয়াড।” সামরিক ব্যাখ্যায়, ‘প্ল্যাটুন’-এর তুলনায় ‘স্কোয়াড’ আকারে ছোট। একটি ‘প্ল্যাটুন’-এ দুই বা তার বেশি ‘স্কোয়াড’ থাকে। সংগঠনে এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকলেও লালগড় আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন, ২০০৮-এর ডিসেম্বরে জঙ্গল ছেড়ে, পার্টি ছেড়ে বাড়ি ফেরেন করণ। পার্টির শীর্ষনেতাদের একাংশের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে।
মধ্য তিরিশের ওই যুবকের রাজনৈতিক ঝাঁঝ মেশানো অভিযোগ, “তৃণমূল যা করছে, তা সিপিএমের চেয়েও খারাপ। সিপিএম ৩৪ বছরের রাজত্বের শেষ দিকে অত্যাচার করেছিল। আর এরা ক্ষমতায় আসার দু’বছরের মধ্যেই ভয়ঙ্কর অবস্থা তৈরি করেছে।” তাঁর দাবি, “আমাকে তৃণমূল করতে ক্রমাগত চাপ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মরে গেলেও তৃণমূল করব না। শাসকের রংটাই শুধু পাল্টেছে। অত্যাচার বদলায়নি।”
তা হলে তাঁর মতো অতি-বামপন্থীর প্রতিবাদ এখন লালের বদলে সবুজের বিরুদ্ধে?
মাঝপথে বাধা আসে। “সবুজ বলবেন না, তেরঙা বলুন।”
আসলে ‘সবুজ’ বলতে এলাকার বাসিন্দারা বোঝেন ঝাড়খণ্ডী দল। ‘তেরঙা’ মানে তৃণমূল। কাঁটাপাহাড়ি, ছোটপেলিয়া, দলিলপুরএই সব এলাকা সিজুয়া পঞ্চায়েতের অন্তর্গত। ২০০৮-এ ওই পঞ্চায়েতে জেতে ঝাড়খণ্ড পার্টি-তৃণমূলের জোট। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের পরেই সেই জোট ভেঙে যায়। জোট-সঙ্গীরাই এখন যুযুধান। সিজুয়া পঞ্চায়েতের বর্তমান উপপ্রধান, ঝাড়খণ্ড অনুশীলন পার্টির বাবুলাল মাণ্ডির ক্ষোভ, “ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে তৃণমূল আর জোট করার প্রয়োজন বোঝেনি।”
করণ এখন ঝাড়খণ্ড অনুশীলন পার্টির সক্রিয় কর্মী। সিজুয়ায় ঝাড়খণ্ড অনুশীলন পার্টির শক্তিকরণের মতো প্রাক্তন মাওবাদী বা আন্দোলন-পর্বে মাওবাদীদের সঙ্গে থাকা ছোটপেলিয়া গ্রামেরই যুবক লক্ষ্মণ সোরেনরা। যাঁরা এলাকার ছেলে হিসেবে এলাকার সমস্যা জানেন বলে দাবি করেছেন। লক্ষ্মণের মুখেও বর্তমান সরকার এবং পুলিশের সমালোচনা। একই রাজনৈতিক অবস্থান লালগড়-পর্বে মাওবাদীদের দলে নাম লেখানো, বর্তমানে সরকারি দফতরের অস্থায়ী কর্মী, কাঁটাপাহাড়ির সঞ্জয় প্রতিহারের। সঞ্জয়েরও অভিযোগ, “মাওবাদীদের সঙ্গে ছিলাম বলে আগের সরকার গ্রেফতার করেছিল। এখন ঝাড়খণ্ড পার্টি করি বলে তৃণমূলের লোকজনের কথায় পুলিশ যখন-তখন থানায় ধরে নিয়ে যাচ্ছে, রাতভর আটকে রেখে হেনস্থা করছে। তা হলে কীসের পরিবর্তন?”
সিজুয়া পঞ্চায়েতে এ বার ১০টি আসনের সব ক’টিতেই ঝাড়খণ্ড অনুশীলন পার্টি আর তৃণমূল প্রার্থী দিয়েছে। এবং এ-ই প্রথম সিপিএম এখানে প্রার্থী দেয়নি। সিপিএমের লালগড় লোকাল কমিটির এক সদস্যের বক্তবা, “গত বিধানসভায় সিজুয়া পঞ্চায়েত এলাকায় জনসাধারণের কমিটির প্রার্থী ছত্রধর মাহাতো যা ভোট পেয়েছিলেন, তার পুরোটাই ঝাড়খণ্ড পার্টি পাবে বলে মনে হচ্ছে। তার সঙ্গে আমাদের ভোট এক হলেই সিজুয়া পঞ্চায়েতে তৃণমূলের দফারফা।”
এই সূত্র ধরেই হয়তো তৃণমূলের বিনপুর ব্লক সভাপতি বনবিহারী রায় বলছেন, “কেন জোট করতে যাব ঝাড়খণ্ড পার্টির সঙ্গে? ওদের এখন চালাচ্ছে তো সিপিএম।” শাসক দলের বিরুদ্ধে করণ-সঞ্জয়দের অভিযোগ ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে বনবিহারী বলছেন, “সব মনগড়া কথা। মাওবাদীদের বদলে ঝাড়খণ্ড পার্টির হয়ে বলা হচ্ছে। ওরা সন্ত্রাস করলে পুলিশ তো ধরবেই।” লালগড় থানার পুলিশও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হেনস্থা করার অভিযোগ মানেনি।
তবে করণের দাবি, “বিরোধীদের পিছনে যে ভাবে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাতে অচিরেই নতুন আন্দোলনে নামবেন এলাকার মানুষ।” কিন্তু নতুন আন্দোলনকে দিশা দেবেন কে? আগের আন্দোলন-পর্বে চালিকাশক্তি ছিল যে মাওবাদীরা, তারাই তো কোণঠাসা কিষেণজি মারা যাওয়ার পরে? ফের বাধা দেন প্রাক্তন অতি-বাম নেতা। বলেন, “কিষেণজি মারা গিয়েছেন। কিন্তু দেখে নেবেন, সময়ের দাবিতে জন্ম নেবেন একশো জন কিষেণজি।”
|