সুন্দরবনে মানুষ নেই, সুতরাং বনাধিকার আইন অনুযায়ী বনের উপর অধিকার দাবি করার উপযুক্ত দাবিদার নেই। এই অজুহাতে বন বিভাগ সুন্দরবনের কয়েক লক্ষ বাসিন্দাকে ন্যায্য ও আইনসিদ্ধ অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে বলে অভিযোগ তুলল ‘সুন্দরবন জন শ্রমজীবী মঞ্চ’।
সম্প্রতি গড়ে ওঠা ওই সংগঠনের অভিযোগ, বন বিভাগের কর্মীদের একাংশ সুন্দরবনের জলে-জঙ্গলে বহু দিন ধরে খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের উপর সন্ত্রাস চালাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে ওই মঞ্চ। যদিও এই সব অভিযোগ কার্যত উড়িয়ে দিয়েছেন রাজ্যের বনমন্ত্রী হিতেন বর্মন এবং সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা।
গত ৬ জুন ওই মঞ্চের তরফে সুন্দরবনের সামশেরনগর থেকে শুরু হয় ‘জনচেতনা ও অধিকার যাত্রা’ নামে একটি জাঠা। কুমিরমারী দ্বীপ, ছোট মোল্লাখালি, সাতজেলিয়া ও গোসাবার সোনারগাঁ হয়ে বালিদ্বীপে সত্যনারায়ণপুরের সাতেরকণায় ১৫ জুন জাঠা শেষ হয়। ওই জাঠা থেকে ‘বনাধিকার আইন, ২০০৬’ চালু করা এবং বন বিভাগের সন্ত্রাস বন্ধের দাবি তোলা হয়। বিভিন্ন জায়গায় জাঠাকে বাধা দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক, গোসাবার রাধানগরের বাসিন্দা তাপস মণ্ডলের। তাঁদের অভিযোগ, এক শ্রেণির বনকর্মীর প্ররোচনাতেই অনেক সময়ে পুলিশ তাঁদের বাধা দিয়েছে।
সুন্দরবনের বননির্ভর মানুষের উপর ‘কোর বাফার’-এর ফতোয়া চাপানো যাবে না বলে দাবি তুলেছে ওই মঞ্চ। তাদের আরও বক্তব্য, সুন্দরবনের সর্বত্র ‘বনাধিকার আইন, ২০০৬’ অনুযায়ী বিনা শুল্কে ও বিনা বাধায় মাছ, কাঁকড়া, মধু, ক্যাওড়া ও অন্য বনজ সম্পদ সংগ্রহ করতে বাধা দেওয়া চলবে না। বনাধিকার আইনে গ্রামসভা গঠনের কথা বলা হলেও সুন্দরবনে এখনও তা একটিও গঠিত হয়নি।
তাপসবাবু বলেন, “আমাদের দাবি, পারমিট-রাজ বাতিল করে বনাধিকার আইন অনুযায়ী গ্রামসভা গঠন করতে হবে। গ্রামসভায় আলোচনা করেই বন থেকে মধু-সহ লঘু বনজ সম্পদ সংগহ কোথায় কী ভাবে করা হবে, তা ঠিক করা হবে।” তবে বনমন্ত্রীর বক্তব্য, “গ্রামসভার ভাবনা পুরনো। আগের সরকারের আমলে এই সব ভাবা হয়েছিল। ওরাও করতে পারেনি। বরং, গ্রাম পঞ্চায়েতে যে গ্রাম সংসদের কথা বলা হয়েছে তা অনেক বাস্তবসম্মত। আমরা গ্রাম সংসদ গঠনের ব্যাপারে উৎসাহী।”
মঞ্চের অভিযোগ, সুন্দরবনে প্রায়ই মৎস্যজীবীদের কাছ থেকে মাছ, কাঁকড়া-সহ নৌকা, মাছ ধরার সরঞ্জাম লুঠ করে নেয় এক শ্রেণির বনকর্মীরা। কখনও-কখনও বন বিভাগ থেকে সেগুলি বিনা কারণে আটকও করা হয়। কিন্তু আটক জিনিসের কোনও ‘সিজার লিস্ট’ দেওয়া হয় না। মধু সংগ্রহকারীদের বন উন্নয়ন নিগমের কাছে মধু বিক্রি করতেও বাধ্য করে বন দফতর। সংগৃহীত মধু খোলা বাজারে করতে দেওয়ার দাবিও তোলা হয়েছে। সুন্দরবনের মধু সংগ্রাহক এবং মৎস্যজীবীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা প্রশাসনকে করতে হবে বলে দাবি তুলেছেন মঞ্চের অন্যতম সংগঠক সৌমিত্র ঘোষ।
সুন্দরবনের জলে-জঙ্গলে বাঘ বা অন্য জন্তুর আক্রমণে কোনও শ্রমজীবীর মৃত্যু হলে সরকারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলে দীর্ঘদিন ধরেই দাবি রয়েছে। জখমদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দাবিও বহু দিনের। কিন্তু এ ব্যাপারে বন বিভাগ বা সুন্দরবন উন্নয়ন বিভাগের কোনও হেলদোল নেই বলে সৌমিত্রবাবু অভিযোগ করেন। তাঁর আরও দাবি, “অনেক সময়ে বন বিভাগের কর্মীরা জঙ্গলের ভিতরে মৎস্যজীবী ও মধু সংগ্রহকারীদের মতো বননির্ভর মানুষের নৌকা কেড়ে নিয়ে তাঁদের বনেই ফেলে রেখে চলে আসে। যা আক্ষরিক অর্থেই তাঁদের বাঘের মুখে ফেলে আসা।”
যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বনমন্ত্রী অবশ্য বলেন, “কেউ যদি বিনা লাইসেন্সে বনে ঢুকে মধু সংগ্রহ করে বা মাছ ধরে, তা হলে তাদের দায়িত্ব বন দফতর নেবে না।” মঞ্চের তোলা অভিযোগগুলি উড়িয়ে দিয়েছেন সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রীও। তাঁর বক্তব্য, “বনে ঢুকে যারা যথেচ্ছ ভাবে গাছ কাটে, তাদের বিরুদ্ধে বনকর্মীরা ব্যবস্থা নেয়। এ ক্ষেত্রে অন্যায় কিছু দেখছি না।” আটক করা নৌকা, জাল, মধুর ‘সিজার লিস্ট’ কেন দেওয়া হয় না জানতে চাইলে দুই মন্ত্রীই তা এড়িয়ে গিয়েছেন।
|