মোল্লা নাসিরুদ্দিন যে ভুল করিয়াছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও তাহা করিলে মুশকিল। মোল্লার কাহিনি সংক্ষিপ্ত। তিনি নিজেই রাজবাড়িতে ভোজের গুজব ছড়াইয়াছিলেন, এবং সকলে যখন সেই গুজব বিশ্বাস করিয়া রাজবাড়ির দিকে দৌড়াইতে আরম্ভ করিল, তিনি নিজেই দৌড়াইয়াছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আখ্যানটি, স্বভাবতই, জটিলতর। তিনি রাজ্যের রাজকোষের হাঁড়ির হালের কথা বিলক্ষণ জানেন। ইহাও জানেন যে রাজ্যের হাতে আয় বাড়াইবার বিশেষ ক্ষমতা নাই। তাঁহার অর্থমন্ত্রী প্রবেশ কর বসাইয়া কিছু টাকা তুলিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন— আদালত তাহাকে ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করিয়াছে। এমতাবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য ছিল, তিনি ব্যয় কমাইয়া রাজকোষের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করিবেন। কিন্তু সবার উপরে রাজনীতি সত্য। মুখ্যমন্ত্রী এই অর্থাভাবের একটি রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি করিয়াছেন— সি পি এম-এর ধারের বোঝা তিনি বহিবেন না, অতএব কেন্দ্রীয় সরকারকে সেই ঋণ মকুব করিয়া দিতে হইবে। অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, রাজকোষের বেসামাল অবস্থার সমাধানসূত্র ব্যয়হ্রাসে নাই, আছে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। ইউ পি এ সরকার, বন্ধুত্বে এবং বিচ্ছেদে, এই দাবি মানিতে সম্মত হয় নাই। এখন বিভিন্ন জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী বলিতেছেন, ২০১৪ সালে ফেডারেল ফ্রন্ট সরকার আসিয়া ঋণ মকুব করিয়া দিবে। সম্ভবত সেই ভরসাতেই তিনি সরকারের ব্যয়ভার বাড়াইয়া চলিয়াছেন। এইখানেই তাঁহার চলনটি নাসিরুদ্দিন-সদৃশ হইয়াছে। নিজের গল্প নিজেই বিশ্বাস করিয়া ফেলিয়াছেন তিনি।
বাস্তব হইল, তাঁহার রাজকোষে অর্থ নাই। অমিত মিত্র রাজ্যের সাংবিধানিক গণ্ডির মধ্যে থাকিয়া ব্যয় বাড়াইতে পারিবেন কি না, তাহা অনিশ্চিত। ভবিষ্যতের কোনও কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের ঋণের বোঝা লাঘব করিবে কি না তাহা ভবিষ্যৎ বলিবে। আপাতত মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য ছিল সাধ্যানুসারে ব্যয় করা। তিনি বিপরীতবিহারে বিশ্বাসী। ফলে, রাজ্যের ব্যয়ের বোঝা বাড়িয়াই চলিয়াছে। সরকারি পরিবহণ সংস্থা ক্রমেই আরও ভর্তুকি-নির্ভর হইয়া উঠিতেছে। বিদ্যুৎ সংস্থাও সরকারের মুখাপেক্ষী। কোনও ক্ষেত্রেই পরিষেবার সম্পূর্ণ মূল্য আদায়ের তাগিদ নাই। অন্য দিকে মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতির ঝুলি লইয়া বসিয়াছেন। বিপন্ন আর্থিক সংস্থার টেলিভিশন চ্যানেলের কর্মীদের বেতনও তিনি দিবেন, আবার ইমামদের মাসোহারাও। সারদা গোষ্ঠীর প্রকল্পে যাঁহাদের টাকা মার গিয়াছে, তাঁহাদের জন্যও মুখ্যমন্ত্রী তহবিল খুলিয়াছেন। ক্লাবে-ক্লাবে টাকা দেওয়ার কথাও স্মর্তব্য। ও দিকে আবার বেকারদের ভাতা দেওয়ার ঘোষণাটি তাঁহার অর্থমন্ত্রীকে বিপাকে ফেলিয়াছে। এত খয়রাতির টাকা কে জোগাইবে? টাকা জোগাড় করিতে না পারায় প্রতিশ্রুতিভঙ্গও হইতে পারে। ইহা প্রশাসনের পথ নহে। মুখ্যমন্ত্রীকে নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝিতেই হইবে। এখন আরও বেশি, কারণ প্রবেশ কর আদায়ের রাস্তাও সম্ভবত বন্ধ হইল। |