সন্ত্রাসবাদীরা হামলা চালাইয়াছিল। চলমান সেনা-কনভয়ের উপর আক্রমণ করিয়া রাজধানী শ্রীনগরের হায়দরপোরা বাইপাসে আট জওয়ানকে তাহারা হত্যা করে। জেহাদি জঙ্গিদের সমর্থক হুরিয়ত নেতৃত্বও শ্রীনগরে বন্ধ পালনের ডাক দেয়। লক্ষ্য ছিল, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং ইউ পি এ সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর কাশ্মীর সফর বানচাল করা। কিন্তু জেহাদি ও সন্ত্রাসবাদীদের সেই লক্ষ্য সফল হয় নাই। উভয়েই যথানির্দিষ্ট সময়ে ও স্থানে পৌঁছাইয়া জম্মু ও কাশ্মীরের উন্নয়নে অপরিহার্য রেলওয়ে প্রকল্প বানিহাল-কাজিগুন্দ রেলপথের উদ্বোধন করেন। এই রেলপথ নির্মাণ করিতে গিয়া হিমালয়ের পির-পঞ্জল পর্বতমালা ভেদ করিয়া সওয়া এগারো কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সুড়ঙ্গপথ বানাইতে হইয়াছে। কিন্তু এই সংযোগপথ জরুরি ছিল, কেননা রাজ্যের দীর্ঘস্থায়ী শীতকালে অবশিষ্ট দেশ হইতে স্থলপথে শ্রীনগর উপত্যকার বিচ্ছিন্নতা দূর করিতে এই রেলপথ ছাড়া উপায় ছিল না। রাজ্যের অর্থনীতি, রাজ্যবাসীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যক এমন একটি প্রকল্পের উদ্বোধন বানচাল করিতে যাহারা সন্ত্রাস করিল, তাহারা যে কাশ্মীরিদের মঙ্গল চায় না, সে বিষয়ে কোনও সংশয় থাকিতে পারে না।
কাশ্মীর-বিতর্কটি যে ক্রমেই সার্বভৌমত্ব তথা বিচ্ছিন্নতার চোরাবালি হইতে উত্তীর্ণ হইয়া উন্নয়ন ও জনকল্যাণের প্রশ্নে স্থানান্তরিত হইয়াছে, জেহাদিদের ইহা পছন্দ হইতেছে না। কেননা ইহা উত্তরোত্তর জেহাদি সন্ত্রাসকে উপত্যকার জনমানসে অপ্রাসঙ্গিক করিয়া দিতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা যে ভাবে রাজ্যের উন্নয়নে উদার হস্তে অর্থ-বরাদ্দ মঞ্জুর করার তালিকা দিতেছেন, তাহাতে মনে হয়, উন্নয়ন প্রকল্পের রূপায়ণই এখন রাজ্য সরকারেরও প্রধান মাথাব্যথা। মরিয়া সন্ত্রাসীরা তথাপি ইতস্তত হামলা চালাইয়া জনজীবন বিপর্যস্ত করিয়া দিতে উদ্যত হইবে। তাহাদের সমর্থক হুরিয়ত নেতারাও প্রাণপণে নিজেদের অবান্তর হইয়া পড়া ঠেকাইতে উপত্যকায় থাকিয়া-থাকিয়া বন্ধ-এর ডাক দিতে পারেন। কিন্তু আশা করা যায়, তাহাতে কাশ্মীরের প্রকৃত কর্তব্য পাল্টাইবে না, তাহাকে গত শতাব্দীর আশি-নব্বই দশকের গৃহযুদ্ধপ্রতিম নৈরাজ্যের দিকে ফিরাইয়া লওয়া যাইবে না। হুমকি, হত্যা, সন্ত্রাস ও রক্তক্ষয়ের দীর্ঘ রাত্রি পিছনে ফেলিয়া উপত্যকার মানুষ স্বাভাবিক উন্নয়নের দিশা হাতড়াইতেছেন। উপর্যুপরি নির্বাচনে জঙ্গি হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করিয়া তাঁহাদের যোগদানের মধ্যে তাহা প্রমাণিতও। প্রধানমন্ত্রী এবং ইউ পি এ সভানেত্রীও যে হুমকি অগ্রাহ্য করিয়া কাশ্মীর সফর জারি রাখেন, তাহার পিছনেও স্বাভাবিকতায় ফেরার এই সংকল্প। অচিরেই অমরনাথের উদ্দেশে তীর্থযাত্রা শুরু হইতে চলিয়াছে। অতীতে এই যাত্রাপথে জঙ্গিরা নিরস্ত্র পুণ্যার্থীদের উপর স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র হইতে গুলিবর্ষণ করিয়া নিজেদের বীরত্বের পরিচয় দিয়াছে। ভবিষ্যতেও যাহাতে তেমন অঘটন না ঘটে, সে জন্য মুখ্যমন্ত্রী সেনা ও পুলিশের শীর্ষ আধিকারিকদের সহিত বৈঠক করিয়াছেন। তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তার আশ্বাসও দেওয়া হইয়াছে। তাঁহারাও সেই আশ্বাসে ভরসা করিয়া হাজারে-হাজারে সমবেত হইতেছেন। যাত্রীরা হিন্দু হইলেও যাত্রাপথের দুই ধারে দরিদ্র মুসলিম জনসাধারণের সহযোগিতাই তাঁহাদের পাথেয় হইয়া থাকিবে। যুগ-যুগ ধরিয়া এ ভাবেই চলিয়া আসিতেছে। জঙ্গিরা এই পারস্পরিকতার ধারাবাহিকতা নাশ করিতে চাহিয়াছে। কিন্তু কাশ্মীরিরা ভয়ে কিংবা ভক্তিতে তাহাদের যাবতীয় অনাচারের কাছে নত হইয়াছেন, এমন নয়। এই ইতিবাচকতাই কাশ্মীরের বৈশিষ্ট্য। একদা ইহাকেই ‘কাশ্মীরিয়ত’ বলা হইত, প্রকৃতপক্ষে যাহা ছিল ‘ইনসানিয়ত’ বা মনুষ্যত্বেরই অপর নাম। জেহাদি সন্ত্রাস ও তাহার মোকাবিলায় সরকারি দমননীতির দ্বৈরথের পর্যায়েও তাহা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয় নাই, তাহার অবশেষ বাঁচিয়া ছিল। এখন সমগ্র দেশবাসী তাহার সার্বিক পুনরুজ্জীবন দেখিতে চায়। সন্ত্রাসবাদীরা স্বভাবতই এই পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগকে বিনাশ করিতে তৎপর হইবে। সেই কারণেই দলমতনির্বিশেষে সমস্ত সংশ্লিষ্ট নাগরিক এবং প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব উপত্যকায় স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় সর্বতোভাবে সাহায্য করা। ইহা কেবল কাশ্মীরের পরীক্ষা নয়, ইহা ভারতীয় গণতন্ত্রের পরীক্ষা। |