ধান্যরুখী গ্রামে সিপিএমকে বাঁচিয়ে রেখেছে একটা নাম
কাটোয়া শহর ছেড়ে কিছুটা বেরিয়ে ফুলবাগান-খুদরুন পিচ সড়ক থেকে ডান দিকে মোরাম রাস্তা। কাদামাখা ওই রাস্তা ধরে কিলোমিটারখানেক গেলেই প্রাথমিক স্কুল। সেই স্কুল পেরোতেই প্রথম চোখে পড়ল সিপিএমের দেওয়াল লিখন‘ফাল্গুনী মুখার্জীর আত্মার শান্তি কামনায় কাস্তে-হাতুড়ি-তারা চিহ্নে ভোট দিন’। গ্রামের ভিতরেও অধিকাংশ বাড়ির দেওয়ালেও জ্বলজ্বল করছে সিপিএম।
কংগ্রেস নেই, তা নয়। তবে, গ্রামের গোটা কয়েক বাড়ির (মূলত দলেরই সমর্থকদের) দেওয়ালেই সীমাবদ্ধ তাদের প্রচার। আর তৃণমূল? দূরবীণ দিয়ে খুঁজলেও শাসকদলের চিহ্ন পাওয়া যাবে না। কোনও দেওয়ালেই নেই ঘাসফুলের প্রচার। দলের তরফে প্রার্থী এক জন আছেন বটে। তবে, পাশের গ্রামে তাঁর বাড়ি।
পরিবর্তনের মঙ্গলকোটে আজও এতটাই অপরিবর্তিত ধান্যরুখী! আজও সে এতটাই সিপিএমের।
সেই ধান্যরুখী, যার সৌজন্যে রাতারাতি এ রাজ্যের রাজনৈতিক সন্ত্রাসকবলিত এলাকার মানচিত্রে নাম উঠেছিল মঙ্গলকোটের। সেই ধান্যরুখী, আজ থেকে চার বছর আগে এমনই এক জুন মাসে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের তাড়া খেয়ে যে গ্রামের ধানখেত ধরে ধুতি তুলে পড়িমড়ি ছুটতে হয়েছিল প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুইয়াঁকে। সিপিএমের মারে লুটিয়ে পড়েছিলেন একাধিক কংগ্রেস বিধায়ক, নেতা-নেত্রী ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি।
বস্তুত, কাটোয়া শহর (ঐতিহ্যগত ভাবেই কংগ্রেস শক্তিশালী) বাদ দিলে অজয়-ভাগীরথীর তীরবর্তী অঞ্চল (মঙ্গলকোট, কেতুগ্রাম) এবং বর্ধমান জেলার দামোদর অববাহিকা ছিল এক কথায় ‘লাল গড়’। এখানে শেষ কথা বলত সিপিএম। যেমন বলত, কেশপুর, গড়বেতা, খানাকুলে। ২০১১ সালে পরিবর্তনের সুনামিতে এই সব জায়গাতেই ধুয়ে মুছে গিয়েছে লাল রং। মঙ্গলকোটও আলাদা নয়। কিন্তু, অদ্ভুত ভাবে ধান্যরুখী ওই গোটা ব্লকে একটা বিচ্ছিন্ন লালদ্বীপ হিসাবে থেকে গিয়েছে। পালাবদলের এত দিন পরেও।
ধান্যরুখীতে সিপিএমের দেওয়াল লিখন। —নিজস্ব চিত্র
অথচ এমন নয় যে, ধান্যরুখী সিপিএমের সন্ত্রাস দেখেনি। বরং খুব কাছ থেকে দেখেছে। সিপিএমের কাজকর্মে এখানকার বাসিন্দাদের বড় অংশই ক্ষুব্ধ নন, এমনটাও নয়। তবু কী করে সিপিএমের এমন দাপট?
এই রহস্যের পিছনে রয়েছে একটাই নামফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়। ২০০৯ সালের ১৫ জুন ধান্যরুখীর কাছেই খেঁড়ুয়া গ্রামে গুলি করে খুন করা হয় বর্ধমান জেলা পরিষদের তৎকালীন বিদ্যুৎ কর্মাধ্যক্ষ, মঙ্গলকোটের দাপুটে ওই সিপিএম নেতাকে। তার জেরে ধান্যরুখী তো বটেই, লাগোয়া শ্যামবাজার, খেড়ুয়া-সহ একাধিক গ্রামে সিপিএম তাণ্ডব চালিয়েছিল। বিরোধীদের বাড়িতে আগুন, ভাঙচুর, লুঠপাটকিছুই বাদ ছিল না। মঙ্গলকোট পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি ফাল্গুনীবাবুকে বরাবর কংগ্রেস-তৃণমূল ‘সন্ত্রাসের নায়ক’ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। সন্ত্রাসের সেই ইতিহাসের জন্যই মঙ্গলকোটে ক্ষমতার পাশা বদলেছে।
ব্যতিক্রম ধান্যরুখী। চার বছর পরেও ওই নামটাই এখানে অক্সিজেন জুগিয়ে যাচ্ছে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের। এতটাই যে তৃণমূল ওই গ্রামে কোনও প্রার্থীই খুঁজে পায়নি! দেওয়ালে, পোস্টারে, প্রচারেসর্বত্র সিপিএমের মুখ এখানে মঙ্গলকোট পঞ্চায়েত সমিতির ওই প্রাক্তন সভাপতি। বিধানসভা ভোটে মঙ্গলকোট কেন্দ্রে সিপিএম জিতেছিল মাত্র ১২৬ ভোটে। সৌজন্যে এই ধান্যরুখী বুথ, যেখানে সিপিএমের ‘লিড’ ছিল ১২২ ভোট। দু’বছর পরের পঞ্চায়েত ভোটও এখানে আবর্তিত হচ্ছে ওই নামকে ঘিরেই। “ফাল্গুনীবাবু খুব বড় মাপের সংগঠক ছিলেন। গ্রামের মানুষ তাঁকে মানত। তাই হয়তো ধান্যরুখীতে এখনও সিপিএমের পতাকা উড়ছে। তবে এ বার লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি।”বলছেন কাটোয়ার কংগ্রেস বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ও।
মরে গিয়েও ধান্যরুখীতে এতটাই জীবিত এই নেতা! ধান্যরুখীর ভোটে এতটাই প্রাসঙ্গিক।
গ্রামের ভিতরে পাকা শহিদ বেদি লাল পতাকায় মোড়া। ভিতরে রাখা ফলকে লেখা, ‘ফাল্গুনী মুখার্জী অমর রহে’। আশপাশের গাছে-বাড়িতে সিপিএমের দলীয় পতাকা। সেই বেদির সামনে দাঁড়িয়েই সিপিএম কর্মী সুশীল পাল, গ্রামবাসী তাপস ঘোষ, সুদর্শন মাঝিরা বললেন, “ফাল্গুনীদার নামেই তো ভোট হচ্ছে! চার বছর পরেও খুনিদের সাজা হয়নি। মানুষ সব দেখছে। আর ফুঁসছে।” এই গ্রামেরই বাসিন্দা, মঙ্গলকোট পঞ্চায়েত সমিতির সিপিএম প্রার্থী সুখী মাঝির কথায়, “ফাল্গুনীদার নামেই ভোট চাইছি।” ফাল্গুনীবাবুকে কোলেপিঠে মানুষ করেছেন যিনি, অশীতিপর সেই সরোজিনী ঘোষ শহিদ বেদির সামনে বসে বললেন, “ছেলেটাকে মেরে ফেলল। অথচ কেউ সাজা পেল না!”
ফাল্গুনী-হত্যায় তৃণমূলের অনেক নেতা-কর্মীর সঙ্গেই অভিযুক্ত হিসাবে নাম ছিল নিহত নেতার প্রতিবেশী, গ্রামের প্রবীণ কংগ্রেস নেতা অমর পালের। সেই অমরবাবুই এ বার ধান্যরুখী সংসদ (কংগ্রেস পরিচালিত ভাল্যগ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত) থেকে কংগ্রেসের প্রার্থী। অন্য সব এলাকার তুলনায় এখানেই আলাদা ধান্যরুখীর ভোট। যেখানে নিহত নেতার স্মৃতি আঁকড়ে ভোটের যুদ্ধে সিপিএম। আর কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী নেমেছেন তাঁর গায়ে সেই হত্যায় অভিযুক্ত হিসাবে সেঁটে থাকা তকমা সরানোর মরিয়া লড়াইয়ে। দোতলা পাকা বাড়ির বারান্দায় ছোট্ট নাতিকে কোলে বসিয়ে অমরবাবু বলছিলেন, “আমার পরিবার সিপিএমের অনেক অত্যাচার সহ্য করেছে। আমার নাতনিকে অজয় নদে ডুবিয়ে মারার চেষ্টাও হয়েছে। তবু লড়াই থেকে পালাইনি। কারণ, আমার অনেক কিছু প্রমাণ করার আছে।” লড়াইয়ে হার হলে? ধীরস্বরে বললেন, “বুঝব এখানকার লোক আমাকে মনেপ্রাণে মেনে নেয়নি।”

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.