তাঁদের চেহারাটা যেন পঞ্চায়েতরাজ আর গণতন্ত্রের সামনে আস্ত একটা বিদ্রুপ।
ভোটের পরিচয়পত্রের বয়স অনুসারে তাঁরা মধ্যবয়সী। তবে অভাব তাঁদের পৌঁছে দিয়েছে বার্ধক্যে। সাড়ে তিন দশকের পঞ্চায়েতিরাজে তাঁদের দুর্গতি একটুকুও কমেনি। বস্তুত স্থানীয় রেশন ডিলারের দয়াতেই বেঁচে রয়েছেন ওই দম্পতি।
পাট্টা পাওয়া সরকারি খাস জমির উপর তাঁদের পাঁচ ফুট বাই আট ফুটের অসম্পূর্ণ পতনোন্মুখ একটি খুপরি। মাথার উপর ভাঙাচোরা কয়েকটি টালির ছাউনি। ওই টালির ছাউনির ফাঁক গলে বৃষ্টির জল ঝুপড়িতে পড়ে। দেওয়াল বলতে কয়েকটি আঁটি কঞ্চি কোনও মতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কী শীত! কী বর্ষা! কঞ্চির বাকি বেড়ায় কাদামাটি লেপার শারীরিক ক্ষমতাও খুইয়েছেন হতদরিদ্র দম্পতি। তাঁদের দু’ জনেরই বুকের হাড় ঝাপসা চোখেও গোনা যায়। হাত-পা শুকিয়ে এখন দড়ির মতো। নাম কালু শেখ ও ঠাণ্ডা বিবি। |
তাঁরা উঠে দাঁড়াতে পারেন না। কোনও মতে হামাগুড়ি দিয়ে অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মতো ঘোরাফেরা করতে পারেন বড়জোর। দয়াপরবেশ হয়ে সপ্তাহান্তে বিনা পয়সায় স্থানীয় রেশন ডিলারের পাঠানো ৩ কেজি চালে চলে তাঁদের হা-অন্ন সংসার। মুর্শিদাবাদ-জিয়াগঞ্জ ব্লকের ডাহাপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের কুডুলপাড়া গ্রাম সংসদের বেলুন-বাঘিরাপাড়ার ভোটার। ভোটের ডঙ্কা বাজলেও নির্বাচনে তাঁদের মন নেই। মৃত্যুই বুঝি তাঁদের অহর্নিশি জপমালা।
ঠাণ্ডা বিবি জন্মসূত্রে শারীরিক প্রতিবন্ধী। তাঁর দু’টি পা অসম্পূর্ণ। সরকারি শংসপত্র অনুসারে তিনি শতকরা ৮০ ভাগ শারীরিক প্রতিবন্ধী। স্বামী কালু শেখ একদা সক্ষম থাকলেও কয়েক বছর ধরে স্ত্রীর থেকেও তিনি শারীরিক ভাবে বেশি অক্ষম। পা দু’টি শুকিয়ে মরা সাপের মতো। হাত-পা নড়াচড়া করতে পারে না। বুকের হাড় গোনা যায়। তবুও তিনি ও তাঁর স্ত্রী প্রতিবন্ধী ভাতা থেকে বঞ্চিত।
কালু শেখ বলেন, “পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য ও তাঁর স্বামীকে কত বার বলেছি তবুও স্ত্রী প্রতিবন্ধী ভাতা পায়নি। তাই আমি আর প্রতিবন্ধী শংসাপত্র করিনি।” মুর্শিদাবাদ-জিয়াগঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য মমতা মণ্ডল বলেন, “ভাতা দেওয়ার জন্য আমি নিজে দেখা করে দরখাস্ত চেয়েছিলাম। কিন্তু কালু শেখ কথা শোনেননি।”
১৯৭৮ সালে ৮ শতক খাস জমির পাট্টা পেয়েছিলেন কালু। তাঁর দুই মেয়ে। কালু বলেন, “রোগভোগে ও অর্ধাহার-অনাহারে শরীর বেশি দিন দিল না। দুই মেয়ের বিয়ে দিতে ও পেটে খেতে পাট্টার জমির প্রায় সব টুকু বিক্রি করে দিয়েছি। এখন মাত্র ২ শতক জমিতে ওই ঝুপড়ি আছে। তবুও সরকারি ইন্দিরা আবাস, বা আমার বাড়ি প্রকল্প থেকে মাথার ছাদটুকুও জোটেনি।” সরকারি প্রকল্পে তাঁদের মাথায় ছাদটুকু জোটেনি কেন? মমতাদেবী বলেন, “বিপিএল তালিকার ক্রম অনুসারে সরকারি বাড়ি পাওয়া যায়। যাঁরা যত বেশি দরিদ্র সরকারি বাড়ি পাওয়ার অগ্রাধিকার তালিকায় তাঁরা তত উপরে। গ্রাম পঞ্চায়েতের হাতে রয়েছে ইন্দিরা আবাস যোজনার ৪৫ হাজার টাকার প্রকল্প, পঞ্চায়েত সমিতির হাতে রয়েছে ‘আমার বাড়ি’ যোজনার ১ লক্ষ ১৬ হাজার টাকার প্রকল্প। অগ্রাধিকার তালিকা অনসারে কালু শেখদের বাড়ির অনুমোদন পাওয়ার সময় হয়নি এখনও।’’
কংগ্রেসের দখলে থাকা মুর্শিদাবাদ জিয়াগঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলামের সাফাই, “ওই পরিবারে বিষয়ে আমাকে কেউ কিছু জানায়নি।” কালু ও তাঁর স্ত্রী ঠাণ্ডা বিবি বলেন, “আমাদের অন্নপূর্ণা কার্ড থাকলে বিনা পয়সায় সপ্তাহে ১০ কেজি চাল পেতাম। কিন্তু আমাদের রয়েছে ২ টাকা কেজি দরে সপ্তাহে ৩ কেজি চালের অন্ত্যোদয় রেশনকার্ড। আামাদের দশার কথা ভেবে ২ কিলোমিটার দূরের রেশন ডিলার সাহবুদ্দিন বিনা পয়সায় সপ্তাহে ৩ কেজি চাল বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তাই কই মাছের জান নিয়ে টিঁকে আছি!” |