মাছ সরিয়েছে হুলো। রোজই সরায়। দাদাবাবু রোজই দেখেন, কিন্তু দেখেও দেখেন না।
দাদাবাবুর সাদা জামা, সাদা মনে কাদা নেই। হুলো মিশকালো। তা বলে কি সাদা-কালো মিলমিশ হতে নেই? হুলো ‘ম্যাও’ করে, দাদাবাবু শুনেও শোনেন না। লোকে বলে, হুলো আসলে দাদাবাবুর পোষা।
হুলো অবশ্য একা নয়। পিছে চলে তার ভাই কেলো। নামের মতোই ঘুরঘুট্টি গায়ের রং। আঁধার নামলেই ভ্যানিশ! দু’য়ে মিলে শ্রীরামপুরের জগাই-মাধাই। নামে লোকে কাঁপে।
হুলোর ‘ভাল’ নাম অবশ্য হুলো নয়। পুলিশের খাতায় গোটা গোটা করে লেখা আছে দীপু সিংহ। খুন, ডাকাতি, অপহরণ, তোলাবাজি নিয়ে অন্তত বিশটা মামলা। কেলো ওরফে রঞ্জিত সিংহেরও খুন-টুন মিলিয়ে নয়-নয় করে অনেকগুলো হয়ে গেল।
ভালই চলছিল।
কেলোর ছেলের জন্মদিনে সবুজ টি-শার্ট পরে শ্রীরামপুরের পুরপ্রধান, তৃণমূলের অমিয় মুখোপাধ্যায়কে নিজের হাতে কেক খাইয়ে দিচ্ছিল হুলো। হাসি-হাসি মুখে হাজির ছিলেন প্রাক্তন কাউন্সিলর তথা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক মনু দত্তও। এলাকার ডিওয়াইএফ নেতা তোতা তো প্রায় ঘরেরই ছেলে! |
শুধু কি ওই দিন?
নিন্দুকেরা বলে, মনু দত্তই গোড়া থেকে হুলোদের ‘গডফাদার’। একটি ঘটনায় হুলোর দল যখন পুলিশের গাড়ি পোড়াচ্ছে, সেখানেও তিনি ঠায় বসেছিলেন। শোনা যায়, কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের এক তাবড় নেতারও ছায়া রয়েছে তাদের মাথায়। হুলোর বাবার নামে করা ফুটবল টুর্নামেন্টেও হাজির ছিলেন তৃণমূল ও কংগ্রেসের নেতারা। ছিলেন সিপিএমের এক কাউন্সিলরের স্বামী। মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার কর্তারাও ছিলেন। কংগ্রেসের এক নেত্রীর জন্য ভোটে খাটাখাটনিও করেছে হুলোর শাগরেদ জিমি।
সম্ভবত এই সব যোগাযোগের জোরেই মাহেশে একের পর এক পুকুর বুজিয়ে প্রোমোটারি আর ভাগীরথী থেকে বালি তোলার ব্যবসা অবাধে চালিয়ে গিয়েছে হুলো। সম্প্রতি যে দু’টি পুকুর সে বুজিয়েছে তার একটি সিপিএমের ওয়ার্ডে, অন্যটি কংগ্রেসের। কেউ রা কাড়তে পারেনি। গোলমাল হয়ে যায় গত ৩০ মে দুই যুবককে খুনের ঘটনায় সিকিমের গ্যাংটক থেকে পুলিশ হুলোকে ধরায়। সঙ্গে ধরা পড়েছে তোতা-সহ আরও ছ’জন।
পুলিশ সূত্রের খবর, ২৮ মে রাতে মাহেশে একটি পেট্রোলপাম্পের সামনে সুজিত নামে কেলোর ঘনিষ্ঠ এক জনের সঙ্গে অন্য দুষ্কৃতী দলের দু’জনের গোলমাল হয়। দু’দিন পরে খটিরবাজার এলাকার ওই দুই যুবক, এলাকার দুষ্কৃতী বান্টির শাগরেদ বলে পরিচিত বিশ্বজিৎ কুণ্ডু এবং সুমন্ত চক্রবর্তী ওরফে পাপাইকে নিখোঁজ হয়ে যান। সুজিতের বাড়িতে ডেকে উঠোনে ফেলে পিটিয়ে মারা হয় তাদের। লাথি মেরে নাক-মুখের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়। বুকের উপরে লাফিয়ে ভেঙে দেওয়া হয় পাঁজরের হাড়। প্রতিবেশীরা গোলমালের শব্দ পেলেও ভয়ে থানায় ফোন করেননি। গভীর রাতে দু’জনের দেহ প্লাস্টিকে মুড়ে ঠেলায় চাপিয়ে বন্ধ রামপুরিয়া কটন মিলের জমিতে নিয়ে গিয়ে ঘন জঙ্গলে পুঁতে দেওয়া হয়।
এই খুনের পরেই হুলো-কেলো আর তাদের দলবল এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিল। তাতেই পুলিশের সন্দেহ হয়। শুভঙ্কর এবং নাড়ু নামে হুলোর দুই শাগরেদকে প্রথমে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে গ্যাংটক থেকে সদলবলে হুলো ধরা পড়ে। কেলো অবশ্য তাদের সঙ্গে ছিল না। পুলিশের দাবি, টানা জেরায় ধৃতেরা অপরাধ কবুল করেছে। রামপুরিয়ার জঙ্গলে পোঁতা দেহ দু’টি দেখিয়েও দিয়েছে। এই জেরার সূত্রেই কিছু নেতার সঙ্গে হুলো-কেলোর মাখামাখির হাতে-গরম তথ্য পুলিশের হাতে এসেছে। হুলোর পারিবারিক অনুষ্ঠানের ভিডিও-তেও তার নমুনা মিলেছে।
জেলা পুলিশের এক পদস্থ কর্তার দাবি, “তোতা জেরার মুখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে দুষ্কৃতীদের পরিচয়ের বিষয়টি কবুল করেছে। এমনকী পুলিশের নজর এড়াতে শাসকদলের এক বিধায়কের কলকাতার বাড়িতেই এক দুষ্কৃতীকে রাখা হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে।” বালি তোলা আর প্রোমোটারি ছাড়াও হুলোর ছেলেরা পুরসভার তরফে রাস্তায় টোল ট্যাক্স আদায় করত। বঙ্গেশ্বরী এলাকায় পুরসভার গাড়িতেই ময়লা নিয়ে গিয়ে পুকুর ভরাট হচ্ছিল। পুলিশের হস্তক্ষেপে তা বানচাল হয়।
পুলিশের দাবি, বেআইনি সব কাজেই তৃণমূলের একাধিক নেতাকে তারা টাকা দিয়েছে বলে হুলো জেরায় জানিয়েছে। তবে পুরপ্রধান অমিয়বাবু হুলো-কেলোর সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর দাবি, “কার নামে কে টেন্ডার নিল, সেটা জানা আমার কাজ নয়। বেনামে পুরসভার টোলট্যাক্সের একটা বরাত ওরা নিয়েছিল। পুলিশ নিষেধ করায় বন্ধ করে দিই।” মনুবাবু দাবি করেন, তিনি হুলো-কেলোদের চেনেনই না।
তবু পাপাইয়ের মা মনিকা চক্রবর্তী অভিযোগ করেন, “নেতাদের মদতেই দুষ্কৃতীদের এমন বাড়াবাড়ি। এদের চরম শাস্তি হোক।”
ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়েছে। এখন ‘ম্যাও’ স্যামলাবে কে?
|
আগ্নেয়াস্ত্র-সহ দুই দুষ্কৃতীকে শুক্রবার রাতে রায়দিঘির রাধাকান্তপুরের জয়নাল খেয়াঘাট থেকে গ্রেফতার করল পুলিশ। ধৃতদের নাম জয়নাল বৈদ্য এবং দিলীপ পুরকাইত। প্রথম জনের বাড়ি কুলতলির চুপড়িঝাড়া গ্রামে। দিলীপ কঙ্কনদিঘির বাসিন্দা। পুলিশ জানায়, ধৃতদের কাছ থেকে দু’রাউন্ড কার্তুজ, একটি রিভলভার, ছ’টি তাজা বোমা ছাড়াও রড, শাবল ইত্যাদি উদ্ধার করা হয়েছে। জয়নালের বিরুদ্ধে কুলতলি এলাকায় একটি ধর্ষণের অভিযোগও রয়েছে। পুলিশের অনুমান, ওই এলাকায় তারা ডাকাতির পরিকল্পনা করেছিল। দলে আরও কয়েক জন ছিল। কিন্তু তাদের ধরতে পারেনি পুলিশ। শনিবার ধৃতদের ডায়মন্ড হারবার আদালতে হাজির করানো হয়। বিচারক দু’জনকেই সাত দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। |