যত কাণ্ড মোবাইলকে ঘিরে!
একটি হত্যারহস্যের পরতে পরতে জড়িয়ে গিয়েছে মোবাইল। রহস্যের শুরু মোবাইল ফোনে। রহস্য জট পাকিয়েছে সেই মোবাইলেই।
কী ভাবে?
যিনি খুন হয়েছেন, সেই যুবক একটি বেসরকারি মোবাইল পরিষেবা সংস্থার রিজিওনাল ডিস্ট্রিবিউটর। খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে যে-তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁদের এক জন ওই সংস্থার ম্যানেজার এবং বাকি দু’জন ডিস্ট্রিবিউটর। হত্যার পরে নিহতের দামি আংটি, ঘড়ি, টাকা-ভর্তি মানিব্যাগ, এমনকী মোটরসাইকেল সব কিছুই রয়ে গিয়েছে। আততায়ী নিয়ে গিয়েছে শুধু দু’টি মোবাইল ফোন। অথচ সেই মোবাইল দু’টির একটিও তেমন দামি সেট নয়।
তদন্তাকারীরা জেনেছেন, মোবাইলে ফোন করেই ওই যুবককে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। খুনের আনুমানিক সময়ের দু’ঘণ্টা আগে থেকে নিহতের মোবাইল ফোনের কোনও টাওয়ার লোকেশন পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণও বুঝে উঠতে পারেননি তদন্তকারীরা।
১৬ মার্চ সকালে কৃষ্ণনগরের অদূরে ভাতজংলা এলাকায় রাস্তার ধারে কৃশানু দত্ত (৩০) নামে এক যুবকের ক্ষতবিক্ষত দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁর মাথায় চপার দিয়ে কোপানোর চারটি ক্ষত ছিল।
সম্প্রতি ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্তভার নিয়েছে সিআইডি। তিন জন গ্রেফতার হলেও খুনের পিছনে আপাতদৃষ্টিতে তাঁদের কোনও স্বার্থ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ময়না-তদন্তের রিপোর্ট বলছে, ১৫ মার্চ রাত ২টো নাগাদ কৃশানুকে খুন করা হয়েছে। নিহতের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে কৃষ্ণনগর থানার পুলিশ পরের দিনই সুরজিৎ ঘোষ, দিব্যেন্দু সরকার ও পিনাকী ভট্টাচার্য নামে তিন জনকে তাঁদের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। তিন জনেরই বাড়ি কৃষ্ণননগর এবং লাগোয়া এলাকায়। তিন জনেই এখন জেল-হাজতে আছেন। পিনাকী একটি মোবাইল পরিষেবা সংস্থার ম্যানেজার। তাঁর তত্ত্বাবধানে কৃশানু, সুরজিৎ ও দিব্যেন্দু কমিশনের ভিত্তিতে এক-একটি এলাকার ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করতেন। কৃশানুর কাজের জায়গা ছিল কৃষ্ণনগর এবং পাশ্বর্বর্তী এলাকা। বছর তিনেক ওই কাজ করছিলেন তিনি।
গোয়েন্দারা জেনেছেন, একটি ফোন পেয়ে ১৫ মার্চ রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ বাড়ি থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরোন কৃশানু। যেখানে তাঁর মৃতদেহ মেলে, তার এক কিলোমিটার দূরে একটি বার-কাম-রেস্তোরাঁর প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে ওই রাতে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কর্মী ও ডিস্ট্রিবিউটরদের সেখানে নিমন্ত্রণ ছিল। তদন্তকারীদের বক্তব্য, কৃশানু এবং তাঁর সংস্থার ওই তিন জনই সেখানে মদ্যপান ও খাওয়াদাওয়া করেন। তবে কৃশানু ছাড়া বাকি তিন জন যে রাত ১১টার মধ্যেই রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যান, সেখানকার সিসিটিভি-র ফুটেজ থেকেই তার প্রমাণ পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তার পর থেকে ওই তিন জনেরই মোবাইল ফোনের টাওয়ার লোকেশন বলছে, তাঁরা ছিলেন নিজেদের বাড়ি বা তার আশপাশের এলাকাতেই, যা কিনা ভাতজংলার ঘটনাস্থল থেকে অনেকটাই দূরে।
সিসিটিভি-র ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ কৃশানু একা ওই রেস্তোরাঁ থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিলেন। তার পর থেকে তাঁর ফোনের টাওয়ার লোকেশন পাওয়া যাচ্ছে না।
এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, “কৃশানুর কাছে সে-রাতে দু’টি মোবাইল ছিল। একটিতে ছিল জোড়া সিমকার্ড। অর্থাৎ তাঁর কাছে মোট তিনটি মোবাইল সংযোগ ছিল। কিন্তু কৃশানু রেস্তোরাঁ থেকে বেরোনোর পর থেকে একটিরও টাওয়ার লোকেশন নেই। হতে পারে, তিনি মোবাইল বন্ধ রেখেছিলেন। প্রশ্ন উঠছে, কেন বন্ধ রেখেছিলেন?” তদন্তকারীদের বক্তব্য, একটি ফোনও চালু থাকলে রেস্তোরাঁ থেকে বেরোনোর পরে কৃশানুর গতিবিধি সম্পর্কে আঁচ পাওয়া যেত।
আততায়ীরা কৃশানুকে খুন করার পরে মোটরসাইকেল-সহ সব কিছু ফেলে শুধু তাঁর দু’টি মোবাইলই হাতিয়ে নেয়। কৃশানু আরও তিনটি মোবাইল ব্যবহার করতেন। সে-রাতে তিনি সেগুলো বাড়িতে রেখে যান। কৃশানুর কাকা শেখর দত্ত বলেন, “পুরো ব্যাপারটাই এখনও অন্ধকারে। সিআইডি যাতে এর তদন্ত করে, সেই জন্য আমরা মে মাসে ভবানী ভবনে আবেদন জানিয়েছিলাম। সিআইডি সেই দায়িত্ব নেওয়ার পরে আমরা কিছুটা আশা রাখছি।”
ইদানীং অপরাধ এবং অপরাধের রহস্য উন্মোচনে মোবাইল বড় ভূমিকা নিচ্ছে। কৃশানুর জীবন-জীবিকা এবং হত্যাকাণ্ডে মোবাইলের যে বড় জায়গা ছিল, তা প্রমাণিত। সেই মোবাইল এই রহস্যভেদে হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে কি না, এ বার সেটাই দেখার। |