পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এ যেন এক অন্য ধরনের ঐক্য। বলা চলে মহাজোট। যেখানে হাত ধরাধরি করে একসঙ্গে পথে নামছে সিপিএম-তৃণমূল, সঙ্গে কংগ্রেসও।
তবে এই জোট শুধুই শ্রমিক সংগঠনের পর্যায়ে। উপলক্ষ কলকাতা বিমানবন্দরের বেসরকারিকরণের বিরোধিতা।
কলকাতা বিমানবন্দরকে বেসরকারি হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। ইতিমধ্যে দিল্লি, মুম্বই, হায়দরাবাদ এবং বেঙ্গালুরু বিমানবন্দরের বেসরকারিকরণ হয়েছে। পরের লক্ষ্য হল কলকাতা ও চেন্নাই বিমানবন্দর।
এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করতে ২৮ জুন বিমানবন্দরের সামনে কনভেনশন ডাকা হয়েছে। সেখানে কংগ্রেস-সিপিএম-তৃণমূল সমর্থিত ইউনিয়নের সদস্যদের নিয়ে তৈরি হবে যুক্ত কমিটি। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকছে তৃণমূল। আপাতত ঠিক হয়েছে ২০০৬-এর ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে যে ভাবে প্রায় অচল করে দেওয়া হয় বিমানবন্দর, এ বারেও একই ধাঁচে আন্দোলন হবে।
তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের কথায়, “এখানে রাজনীতি বড় কথা নয়, বিমানবন্দরের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে সকলকে একজোট হতে হবে। অতীতেও বৃহত্তর কারণে বিবদমান দুই রাজনৈতিক দলের ট্রেড ইউনিয়ন হাতে-হাত মিলিয়ে লড়াই করেছে।”
কেন্দ্রের এই প্রয়াসের প্রতিবাদে বিমানমন্ত্রী অজিত সিংহকে চিঠিও লিখেছেন সৌগতবাবু। প্রতিবাদে গত শুক্রবার গণছুটি নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল বাম সমর্থিত কর্মী ইউনিয়ন। যৌথ লড়াইয়ের স্বার্থে তা বাতিল করে ২৮ তারিখের দিকে তাকিয়ে বাম শ্রমিক নেতারা। তাঁদের সর্বভারতীয় সম্পাদক কনভেনশনে থাকতে দিল্লি থেকে আসবেন। বাম সমর্থিত ইউনিয়নের কলকাতার সম্পাদক দীপঙ্কর ঘোষেরও একই বক্তব্য, “কর্মীদের স্বার্থে এখন রাজনৈতিক রং দেখা ঠিক নয়।” একই বক্তব্য কংগ্রেস প্রভাবিত ইউনিয়নের পূর্বাঞ্চলের সম্পাদক জয়ন্ত চক্রবর্তীরও। তিনি বলেন, “সামগ্রিক ভাবে বৃহত্তর স্বার্থে আন্দোলনে নামছি। এর মধ্যে রাজনীতির রং দেখার দরকার নেই। কর্মীদের স্বার্থ দেখাই মূল উদ্দেশ্য।”
২০০৬-এ কর্মী-আন্দোলনের চাপেই বেসরকারিকরণের পথ থেকে সরে আসতে হয় কেন্দ্রকে। পরবর্তীকালে কেন্দ্রের অধীনস্থ বিমানবন্দর-কর্তৃপক্ষ প্রায় ২৪০০ কোটি টাকা খরচ করে কলকাতায় নতুন টার্মিনাল তৈরি করেন। গত মার্চ থেকে তা চালুও হয়। কিন্তু বিমানমন্ত্রক ঠিক করেছে, নতুন বিমানবন্দর বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হবে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বেদপ্রকাশ অগ্রবালের কথায়, “প্রথমে ঠিক হয়, কলকাতার ক্ষেত্রে ৪৯% অংশীদারিত্ব থাকবে চাঙ্গির হাতে। তারা পেশাদারিত্বের সঙ্গে বিমানবন্দরের কাজ পরিচালনা করবে।” পরে মন্ত্রক ঠিক করে, ৭৪% অংশীদারিত্বই দেওয়া হবে বেসরকারি সংস্থার হাতে। এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে এখনও পদক্ষেপ করা না হলেও মন্ত্রকের এই সিদ্ধান্তের কথা জেনে কিছু বেসরকারি সংস্থা আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে বিমান-কর্তৃপক্ষ সূত্রে খবর।
সৌগতবাবুর অভিযোগ, কলকাতা ও চেন্নাই বিমানবন্দরকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা মূলত যোজনা কমিশনের। কেন্দ্রীয় বিমানমন্ত্রী সেইমতোই এগোচ্ছেন। তিনি ‘কি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট সেল’ নামে একটি কমিটি গড়ে দিয়ে কী পদ্ধতিতে এই বেসরকারিকরণ করা যায়, তার রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছেন। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের উচ্চপদস্থ কর্তারা এই কমিটিতে থাকলেও চেয়ারম্যানকে এড়িয়ে সরাসরি মন্ত্রীর কাছেই তাঁদের রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।
দিল্লি-মুম্বই বেসরকারিকরণের সময়ে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বাছাই কিছু কর্মী-অফিসারকে চেয়েছিল বেসরকারি সংস্থাগুলি। কিন্তু ৯০% কর্মীই থেকে যান বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে। ফলে দিল্লির সদর দফতরে এখন বহু অফিসার আছেন, যাঁদের কার্যত কোনও কাজ নেই বা বসার জায়গা নেই। বিমানমন্ত্রক ঠিক করেছে, বেসরকারিকরণ হলে কলকাতা বিমানবন্দরে কর্মরত ১০০ শতাংশ কর্মী-অফিসারকে নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হবে চুক্তিতে।
বেঙ্গল চেম্বারের প্রেসিডেন্ট কল্লোল দত্ত বলেন, “দিল্লি-মুম্বইয়ের মতো বেসরকারি হাতে চলা বিভিন্ন বিমানবন্দরে দেখেছি, যাত্রী-পরিষেবার মান অনেক উন্নত। কলকাতায় তা যথেষ্ট নয়। অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, বেসরকারি হাতে থাকলে পরিষেবা ভাল হয়। আর বেসরকারিকরণ হলেই যে কর্মসংস্থানের উপরে প্রভাব পড়বেই, তা ঠিক নয়। যাঁরা কাজ জানেন ও কাজ করেন, তাঁদের কাজের অভাব হয় না।”
শিল্পমহলের অন্যদেরও বক্তব্য, সরকারি হাতে থাকলেই স্থানীয় কর্মসংস্থানের বিষয়টি যে গুরুত্ব পাবেই, তা সব সময়ে নিশ্চিত করে বলা যায় না। যেমন কলকাতা বিমানবন্দর ও সংলগ্ন এলাকার নানা পরিষেবার জন্য এখনও বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে ভিন্ রাজ্যের অনেক লোককে নিয়োগ করা হয়েছে। বেসরকারিকরণের পরে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের দিকে নজর দিলেই আর শ্রমিকদের সমস্যা হওয়ার কথা নয় বলে মত তাঁদের। |